সাজানো-গোছানো বাসার কোন জিনিসই অক্ষত নেই। সবই ভেঙে চুরমার। ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটার থেকে শুরু করে খাট, আলমারি, সোফা খণ্ড-বিখণ্ড। বাদ যায়নি বাথরুমের বেসিন, কমোডও। দেখলে মনে হয় প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের ক্ষোভ থেকে কোন সন্ত্রাসী তাণ্ডবের শিকার এ বাড়িটি। কিন্তু নজিরবিহীন এ কাণ্ড করেছে জনমানুষের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ। এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তাণ্ডব চালিয়েই শেষ নয়। পুলিশ ওই বাসার মালিক যুবদল নেতা মামুন হাসানকে না পেয়ে তার ভাইয়ের স্ত্রী ও তার কলেজপড়ুয়া দুই কন্যাকে ধরে নিয়ে গেছে। ঘটনাটি ঘটে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর। মিরপুর মনিপুরের বাসিন্দা যুবদল নেতা মামুন হাসান ও তার বড় ভাই মাহাবুব হাসানের পৃথক বাসায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বাসায় তাকে না পেয়ে পুলিশ সদস্যরা তার ও পার্শ্ববর্তী বড় ভাইয়ের বাসায় তাণ্ডব চালায়।
পুলিশ কর্মকর্তারা যৌথবাহিনীর অভিযানের কথা বললেও র্যাবের শীর্ষ একাধিক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, এটি পুলিশের একক অভিযান। এ অভিযানে র্যাবের কোন সদস্য অংশ নেয়নি। গতকাল সরজমিন মিরপুর মনিপুরের ৮৩২ নম্বর অ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় তলায় যুবদল নেতা মামুনের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, দরজার তালা ভাঙা। তিন বেডরুমের বাসা। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে তাণ্ডবের দৃশ্য। বাসার জিনিসপত্র সব সব ছড়ানো-ছিটানো, ভেঙে চুরমার করে রাখা। ড্রয়িং রুমের সোফাগুলো উল্টানো। সোফার হাতলগুলো ভাঙা। ডাইনিং টেবিল ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে আছে। উল্টে পড়ে আছে ফ্রিজ। কম্পিউটার-টেলিভিশন সব কিছুরই খণ্ডাংশ পড়ে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। পড়ে আছে ভাঙা খাট, বিছানাপত্র জড়ো করে রাখা। উবু হয়ে পড়ে আছে বড় কাঠের আলমারি। বাসায় বসে এসব পাহারা দিচ্ছিল রাজু নামে এক কিশোর। যুবদল নেতা মামুনের এক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। রাজু জানান, রাতে পুলিশ এসে এসব করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রতিবেশী জানালেন, মধ্যরাতে মিরপুর থানার ওসি সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ অভিযানে অংশ নেয়। তারা শব্দ শুনে উঠলেও পুলিশ তাদের ঘরে থাকতে বলেছে। পরে তারা আর বাইরে বের হননি। যুবদল নেতা মামুনের বাসা থেকে বেরিয়ে পাশের গলির ৯০৪/১ নম্বর হোল্ডিংয়ে তার বড় ভাই মাহবুব হাসানের একতলা বাসাতে গিয়েও দেখা গেছে একই দৃশ্য। পুলিশের তাণ্ডবে সংসারের এমন কিছু অবশিষ্ট নেই, যা ব্যবহারযোগ্য। ঘরে এসি পর্যন্ত খুলে ফেলা হয়েছে। মাহবুব হাসান পাঁচ বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। লাঠি হাতে কোন রকমে এদিক-সেদিক যেতে পারেন। একরাশ কষ্ট নিয়ে বললেন, আমি রাজনীতির র’-এর সঙ্গেও যুক্ত নই। তবু ওসি সালাউদ্দিন আমার সব কিছু তছনছ করে দিল। দীর্ঘ বাইশ বছর আমি সৌদি আরবে প্রবাস জীবন কাটিয়েছি। জমি কিনে একতলা বাড়ি করে স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে থাকি। তারা আমার সাজানো সংসার তছনছ করে দিয়ে স্ত্রী ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। সভ্য কোন সমাজে এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলে আমার জানা নেই। আমরা কোন দেশে বাস করছি? বলেই কেঁদে ফেলেন তিনি। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলেন, আমার অপরাধ ছোট ভাই রাজনীতি করে। ছোট ভাই প্রাপ্তবয়স্ক, তাকে রাজনীতি থেকে বিরত রাখার ক্ষমতা তো আর আমার নেই। এক ভাইয়ের জন্য আরেক ভাইকে এভাবে হেনস্তা করার কোন আইন কি আমাদের দেশে আছে?
মাহবুব হাসান বলেন, তার বড় মেয়ে মার্জিয়া হাসান আইইউবিতে বিবিএ ৬ষ্ঠ সেমিস্টারে পড়ছেন। আর ছোট মেয়ে মার্জিয়া হাসান সারোজ ইন্টারন্যাশনাল নামে মিরপুর দশ নম্বরের একটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক বাণিজ্য শাখায় পড়ছেন। স্ত্রী মোর্শেদা হাসান লিপি গৃহবধূ। আমরা রাজনীতির সাতে-পাঁচে নেই। তবু পুলিশ ওদের বিনা কারণে ধরে নিয়ে গেল। এমনকি মেয়েদের নিয়ে যাওয়ার সময় কোন মহিলা পুলিশ সদস্যও ছিল না। সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে চলে যায়। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, রাতে পুলিশ এসে দরজা ধাক্কালে তারা দরজা খুলে দেন। ওসি সালাউদ্দিনসহ ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য নিয়ে তাদের বাসায় ঢুকেন। প্রথমেই তারা সবার মোবাইল ফোন নিয়ে নেন। পরে দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে গাড়িতে তোলেন। তারপর পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছেলে মেহেদী হাসান ও তাকে তার মা হাজেরা খাতুনের কক্ষে নিয়ে আটকে রাখেন। পরে একে একে বাসার সব কিছু ভাঙচুর করেন। তারা শুধু ভেতর থেকে ধুমধাম শব্দ পান। চার কক্ষের ওই বাসায় বেডরুম থেকে রান্নাঘর সব ভেঙে ফেলা হয়েছে। ফ্রিজে রাখা কাঁচা মাংস পড়ে আছে মেঝেতে, পড়ে আছে বাটিতে রাখা ডালও। ওয়াশিং মেশিন ভেঙে পড়ে আছে একদিকে। শয়নকক্ষের আলমারি পড়ে আছে খাটের ওপর, খাটও আধভাঙা হয়ে পড়ে আছে। আর দুই বোন মার্জিয়া ও মারিয়ার কক্ষে দেখা গেছে কোরআন শরিফ ও বাদ যায়নি পুলিশের তাণ্ডবের হাত থেকে। মুখ থুবরে পড়ে আছে ভাঙা কম্পিউটার। বইপত্র ছড়ানো-ছিটানো। ওয়্যারড্রোবের পোশাক পড়ে আছে এলোমেলো।
মাহবুব হাসান বলেন, আমি অসুস্থ মানুষ, আমি যে একটু বাথরুম ব্যবহার করবো তার কোন উপায় নেই। শুধু ভাঙচুর করেই ক্ষান্ত হয়নি। অনেক কিছু লুট হয়েছে। সোনাদানা নগদ টাকা কিচ্ছু এখনও পাওয়া যায়নি। এদিকে রাতের অপর এক অভিযানে কল্যাণপুরের স্থানীয় বিএনপি নেতা ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার শামীম পারভেজের বাসাতেও অভিযান চালায় পুলিশ শামীমকে না পেয়ে ওই বাসাতেও ভাঙচুর চালানো হয়। এ ছাড়া রাতে পাইকপাড়ার ৩২১/এ আহমদনগরের রুনু কমিশনারের বাসাতেও অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় রুনুকে বাসায় না পেয়ে তার প্রতিবন্ধী কিশোর ছেলে আমীন মোহাম্মদ শুভ (১৩) ও এফসিএ পড়ুয়া মেয়ে শারমীনসহ কেয়ারটেকারকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে শুভ ও শারমিনকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।
তার বাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়। গতকাল সকাল ১১টার দিকে বিএনপির ঢাকা মহানগরীর যুগ্ম আহ্বায়ক বজলুর রশীদ আনজুর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তার বাসাতেও ব্যাপক ভাঙচুর চালায় মিরপুর থানা পুলিশ।
এদিকে রাতের এ অভিযানের বিষয়টি পুলিশের পক্ষ থেকে যৌথবাহিনীর অভিযানের কথা বলা হলেও এ সময় অন্য কোন বাহিনীর সদস্য ছিল না। মিরপুরের কিছু এলাকাতে যৌথবাহিনী অভিযান চালালেও দুই বাসায় ভাঙচুর করার সময় যৌথবাহিনীর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। ওসি সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে মিরপুর থানা পুলিশ এ অভিযান চালায়। তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। র্যাবের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে র্যাব সদস্যরা ছিল না। র্যাব ওই দুই বাসায় অভিযান চালায়নি। এদিকে রাতে মিরপুর থানার এসআই আতাউর রহমান জানান, আটককৃতদের থানায় রাখা হয়েছে। তাদের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে। অভিযানের বিষয়ে মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার জসিম উদ্দিন ভাঙচুরের বিষয় অস্বীকার করে জানান, ওই অভিযানের সময় ম্যাজিস্ট্রেট, এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের লোকজন ছিল। বাসা থেকে অনেকগুলো পোস্টার ও ব্যানার উদ্ধার করা হয়েছে।
http://mzamin.com/details.php?mzamin=NDcyMQ%3D%3D&sMg=%3D
No comments:
Post a Comment