Saturday 16 November 2013

দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগে ২২ শ কোটি টাকার প্রকল্পের মালিক ওরিয়ন গ্রুপ

দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগে ২২ শ কোটি টাকার প্রকল্পের মালিক ওরিয়ন গ্রুপ
ওয়াছিউর রহমান খসরু, ঢাকা : গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি (মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) ফ্লাইওভার নির্মাণে ওরিয়ন গ্রুপ তাদের বিনিয়োগে দেখিয়েছে ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু এরমধ্যে মাত্র ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯০ টাকা প্রকল্পের ব্যাংক হিসাবে দেখানো হয়েছে। ১০০ কোটি টাকার বাকি অর্থ বিভিন্ন খাতে খরচ দেখানো হয়েছে। যেসব খরচের প্রায় পুরোটাই বায়বীয়। বাস্তবে এসব খরচ হয়েছে কিনা এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে এবং এসব খরচের যৌক্তিক প্রমাণও ওরিয়ন কাগজপত্রে তুলে ধরেনি। যে কারণে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ওরিয়নের দৃশ্যমান বিনিয়োগ মাত্র দেড় লাখ টাকা। এই দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগ করেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা মূল্যের প্রকল্পের মালিক হয়ে গেছে নির্মাতা ও পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপ।


২০০৩ সালের গোড়ার দিকে বেসরকারি বিনিয়োগে (বিওওটি) পদ্ধতিতে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করলে ডজন খানেক দরপত্রের মধ্য হতে কারিগরি দিক বিবেচনা ও সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বেলহাসা-একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটকে কাজ দেওয়া হয়। তাদের দরপত্রে উল্লেখ ছিল ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার মধ্যে নেদারল্যান্ডের আইএনজি ব্যাংক ৮ কোটি ডলার, বেলহাসা সাড়ে ৭ কোটি দিরহাম এবং বাংলাদেশের একম ইঞ্জিনিয়ারিং ২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জালিয়াতির মাধ্যমে কার্যাদেশ দেয়া হয় ৬৬০ কোটি টাকা। বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রকল্পটি বাতিল করলে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ২২ জুন প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। এ সময় নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। ফ্লাইওভার নির্মাণ শেষে এর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওরিয়নের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়েছে। তাই নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু, দৈর্ঘ্য বাড়ানোর নকশা কে অনুমোদন করেছে। ব্যয় বৃদ্ধিই বা কে অনুমোদন করেছে এসবের কোন তথ্য নেই।

বর্তমান সরকারের আমলে নতুন করে নির্মাণ কাজের শুরুর দিকে ওরিয়ন গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে ১৩৩১ কোটি টাকার বিনিয়োগ পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে তাতে বেলহাসা-একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস-এর বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে মাত্র ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু এই টাকা প্রকল্পের ব্যাংক একাউন্টে ছিল না। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায় নগদ ও ব্যাংক তহবিল মিলে প্রকল্পের মোট অর্থ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯০ টাকা। বাকি টাকা পুরোটা খরচ দেখানো হয়েছে।

ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শুরুর আগে কনসালট্যান্ট ফি পরিশোধ দেখানো হয় ৬৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস দেখানো হয় ৩২ কোটি ৪৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এরমধ্যে ড্রইং, ডিজাইন এবং টেন্ডার দলিলপত্র তৈরিতে ৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, সরেজমিনে সার্ভের জন্য ৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, ট্রাফিক স্টাডিতে ৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, মাটি পরীক্ষায় ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, লিগাল ফি ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা, পাইলিং টেস্টে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। জানা গেছে, এসব খরচের অধিকাংশই ভুয়া বা অতিরঞ্জিত। বস্তুত, কৈ-এর তেলে শুধু কৈ ভাজা নয়, এখান থেকে উদ্বৃত্ত তেল নিয়েই নিজের আখের গুছিয়েছেন ওরিয়নের মালিক ওবায়দুল করিম।

বর্তমান সরকারের আমলে নির্মাণ কাজে বিনিয়োগের কথা বলে ওরিয়ন গ্রুপ ব্যাংকগুলো থেকে প্রকল্পের অগ্রাধিকার শেয়ার বিক্রির নামে প্রথম দফায় ৬০০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। ওবায়দুল করিমকে দেশের পাঁচটি ব্যাংক নজিরবিহীনভাবে এই টাকা দেয়। এক্ষেত্রে ব্যাংকের অর্থ বিনিয়োগের কোনো নিয়ম-কানুন মানা হয়নি। ব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে উঠানোর আগে এটাসমেন্ট বা ব্রিফিং হিসেবে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপনের নিয়ম-কানুন এক্ষেত্রে মোটেই মানা হয়নি। কাজ শুরুর আগেই ব্যাংকগুলো থেকে এই অর্থ নেওয়া হয়। জনতা ব্যাংক থেকে ২০০ কোটি, সোনালী ব্যাংক ১৫০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ১৫০ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংক ৫০ কোটি এবং আইসিবি ব্যাংক থেকে নেওয়া হয় ৫০ কোটি টাকা। নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্প প্রতিষ্ঠার আগে ব্যাংকগুলো এই টাকা বিনিয়োগ করতে না চাইলেও সরকারের শীর্ষ মহলের একটি চক্রের চাপে ওবায়দুল করিমকে এই টাকা দিতে বাধ্য হয়।

উল্লেখ্য, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছিল। এছাড়া ফ্লাইওভারের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করা হয়েছিল ত্রুটিপূর্ণ। এসব কারণে ওয়ান ইলেভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রকল্পের কাজ স্থগিত করে এবং পরে টেন্ডার বাতিল করে। প্রথম দিকে মধ্যপ্রাচ্যের নির্মাণ কোম্পানি বেলহাসার কারিগরি অভিজ্ঞতার বিষয়টি বিবেচনা করে কাজ দেওয়া হয়েছিল। তখন এই প্রকল্পে বেলহাসার শেয়ার ছিল ৮০ শতাংশ। পরে বাংলাদেশের বিতর্কিত ব্যবসায়ী ওবায়দুল করিম নানা ছল ছুঁতোয় এ কোম্পানির পুরো কর্তৃত্ব নিয়ে নেন। বেলহাসার নামে মাত্র ৫ শতাংশ শেয়ার রাখেন। পরবর্তীতে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে বেলহাসা এই প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়।

বর্তমান সরকারের আমলে ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিম সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ম্যানেজ করার মাধ্যমে ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ পুনরায় বাগিয়ে নেন। ২০১০ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে নির্মাণ কাজ উদ্বোধনের ব্যবস্থাও করেন তিনি।

চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে প্রকল্পের ইউটিলিটি সার্ভিসের ব্যয়ও সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। চুক্তির প্রথম দিকে ইউটিলিটি চার্জ ধরা হয় ২৫ কোটি টাকা। চুক্তি অনুযায়ী এই টাকা পরিশোধ করার কথা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের। নির্মাণ কাজ শুরু করার সময় নানা কারসাজির মাধ্যমে চার্জ বাড়াতে বাড়াতে ৩৪১ কোটি টাকায় পৌঁছে। এই পুরো ব্যয় সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় ওরিয়ন গ্রুপ। নানা অপতৎপরতার মাধ্যমে ডিসিসিকে এই চার্জ পরিশোধ করতে বাধ্য করা হয়। এরপরও নির্মাণ ব্যয় কয়েক ধাপে বাড়িয়ে ১ হাজার ৩৩১ কোটি করা হয়।

ফ্লাইওভার প্রকল্পে অনিয়ম দুর্নীতির ধারাবাহিকতায় গুরুতর জালিয়াতির আশ্রয় নেয় একটি মহল। মন্ত্রণালয়ের ফাইল থেকে এই প্রকল্প সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র গায়েব হয়ে যায়। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ফাইলটিতে প্রকল্প সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছিল। যা এই প্রকল্পে যে অনিয়ম হয়েছে, সেগুলো প্রমাণের জন্য প্রয়োজন ছিল। দুর্নীতিবাজ বলে পরিচিত ওবায়দুল করিমের ওরিয়ন গ্রুপ এই কাগজপত্র গায়েবের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠে।

পূর্বেই বলা হয়েছে, দুবাইয়ের বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কন্ট্রাক্টিং কোম্পানি ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী ওবায়দুল করিমের মালিকানাধীন ওরিয়ন গ্রুপের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান একম ইঞ্জিনিয়ারিং যৌথভাবে দরপত্র দাখিল করে। যৌথভাবে কাজটি পেলেও দুটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান একত্রে বেলহাসা-একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লি. হিসেবে পরিচিত ও গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে ওবায়দুল করিমের জালিয়াতির কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। ওবায়দুল করিমের ছেলে সালমান করিম ও জামাতা মেহেদী হাসানকে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটির অংশীদার ও পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। এ সময় বেলহাসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদ আহমেদের স্বাক্ষর জাল করে কোম্পানিটি নিবন্ধিত হয়।

ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পের প্রথম থেকেই ওরিয়ন গ্রুপ নানা জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। নানা কূটকৌশলে ফ্লাইওভারের নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি করে ছয় গুণ। যার দায়ভার এখন জনগণকে বইতে হচ্ছে অতিরিক্ত টোল দেওয়ার মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির জালিয়াতির সঙ্গে সরকারের উচ্চ একটি মহলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় বিষয়টি নিয়ে নিশ্চুপ রয়েছে প্রশাসন।

গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি (মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) ফ্লাইওভারে অতিরিক্ত টোল আদায় বন্ধে নির্মাতা ও পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ইতিমধ্যে দুই দফায় চিঠি দিলেও ডিএসসিসিকে পাত্তা না দিয়ে অতিরিক্ত টোল আদায়ে অনড় অবস্থানে রয়েছে বিতর্কিত এই প্রতিষ্ঠানটি। উচ্চ একটি মহলের চাপে ওরিয়নের এই জালিয়াতির বিরুদ্ধে ডিএসসিসি কঠোর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেনা বলেও সূত্র জানায়।

অতিরিক্ত টোলের কারণে অল্প দূরত্বের যানবাহনগুলো ফ্লাইওভার ব্যবহার না করে নিচ দিয়ে চলাচল করছে। এতে করে ফ্লাইওভার ব্যবহার না হয়ে যানজটের তীব্রতা বাড়ছে। এছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় বেশি জায়গা নিয়ে ফ্লাইওভারের নিচে গার্ডার তুলে রাস্তাকে আরও সংকীর্ণ করা হয়েছে। যা রাস্তার নিয়মিত যানজটকে বাড়াচ্ছে।

তবে ওরিয়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনছার আলী শীর্ষ কাগজকে বলেন, আমরা এরই মধ্যে দু’দফায় চিঠি দিয়েছি। তারা বলছে, ওরিয়নের মালিক ওবায়দুল করিম দেশের বাইরে থাকায় তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।

চিঠি বা অনুরোধে অতিরিক্ত টোল প্রত্যাহার না করলে ডিএসসিসির করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা চিঠি দিয়ে এখন অপেক্ষা করছি। যদি এর মধ্যে কোনো পরিবর্তন না হয় তাহলে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেব, আদালত এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবে। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করার পর আইনি ব্যবস্থা ছাড়া কোনো গতি নেই।

এ বিষয়ে কথা বলতে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ (গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি) ফ্লাইওভারের প্রকল্প পরিচালক আশিকুর রহমানকে ফোন দিলে অপরিচিত একজন ফোন ধরে বলেন, ‘এখন উনি এ বিষয়ে কথা বলবেন না। জরুরি হলে অফিসে আসেন।’ অফিসে আসলে কখন পাওয়া যাবে জানতে চাইলে কিছু না বলে ফোন রেখে দেন। তবে ফোনটি আশিকুর রহমানের ব্যক্তিগত না- কি অফিসিয়াল জানতে চাইলে ঐ ব্যক্তি ফোনটি (০১৭৫১৭৭৫১৭৭) আশিকুর রহমানের বলে এই রিপোর্টারকে নিশ্চিত করেন।

শীর্ষ কাগজের সৌজন্যে

No comments:

Post a Comment