দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে ৫২.২২ ভাগ ব্যবসায়ী। ৯৩ জন বা ১৭.২২ ভাগের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি বা এর চেয়ে কম। হত্যা মামলার আসামি ১২ জন। এছাড়া, ৮৬ জন প্রার্থী আয়কর বিবরণী জমা দেননি। ৪১.৮৫ ভাগ প্রার্থী ঋণগ্রহীতা। যেসব প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাদের অনেকে সাংবিধানিকভাবে নির্বাচনের অযোগ্য। গতকাল সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সুশাসনের জন্য নাগরিক-(সুজন) এ তথ্য প্রকাশ করে। নাগরিক এ সংগঠনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ তথ্য তুলে ধরে বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনটি অগ্রহণযোগ্য। কারণ এতে ৫৩ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন না। তবুও আমরা সচেতন মহলসহ ভোটারদের জ্ঞাতার্থে প্রার্থীদের তথ্যসমূহ তুলে ধরছি। তিনি বলেন, আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে মোট প্রার্থীর সংখ্যা ৫৪৩। ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেও আদালতের নির্দেশে কুমিল্লা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এএসএম কামরুল প্রার্থিতা ফিরে পান। তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা ১৫৩। এর মধ্যে ৫৪০ জন নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় তথ্য জমা দিয়েছেন
। ৩ জন প্রার্থীর তথ্য হলফনামায় উল্লেখ নেই। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের জমা দেয়া হলফনামায় ওই প্রার্থীরা শিক্ষাগত যোগ্যতা, অতীত এবং বর্তমান ফৌজদারি মামলা, নিজের এবং নির্ভরশীলদের বাৎসরিক আয়, এবং স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের বিবরণ দায়-দেনা ও ঋণ সংক্রান্ত তথ্য এবং আয় জমা দিয়েছেন। তবে, তথ্যসমূহের সঠিকতা সমপর্কে আমরা নিশ্চিত নই। অনেকের হলফনামায় অনেক তথ্য গোপন করা হয়েছে এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া হয়েছে। বদিউল আলম বলেন, ২৭শে ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে সুজন যেসব প্রার্থীর সম্পদের বিবরণ তুলে ধরেছিল এর মধ্যে ৩ জন প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এছাড়া, একজন মামলা করার হুমকি দিয়েছেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুজনের নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. শাহদীন মালিক বলেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাদের অনেকেই সাংবিধানিকভাবেই প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য। হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী অনেকেই সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা করে মুনাফা লাভ করেছেন। তারা স্পষ্টই সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। সংবিধানে বলা আছে, মন্ত্রী-এমপিরা সরকারের সঙ্গে কোন ধরনের ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িত থাকতে পারবেন না। এমন কি আইন পেশার সঙ্গে জড়িত থাকলেও তারা প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এছাড়া, তাদের স্ত্রীরাও যদি কোন ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়ালে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ- আরপিও ১৯৭২-এর ১২ (কে) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোন সংসদ সদস্য যদি সরকারের সঙ্গে কোন ধরনের ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িত থাকেন তাহলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য বলে বিবেচিত হইবেন।’ তিনি বলেন, ৫ই জানুয়ারি তামাশার নির্বাচন হচ্ছে। তামাশায় যেমন অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকেন তেমনি আগামী নির্বাচনের প্রার্থীরা আইন ভঙ্গ করে তামাশার অভিনেতা-অভিনেত্রীর ভূমিকা পালন করছেন।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সুজনের নির্বাহী কমিটির সদস্য আলী ইমাম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় প্রার্থীরা সম্পদের যে মূল্য দেখিয়েছেন তা বর্তমান বাজার অনুযায়ী দেখাননি। এছাড়া, একটি মহল নির্বাচন কমিশনে তথ্য জমা দেয়ার বিধান বাতিল করতে অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর জন্য আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেন, নির্বাচন কমিশনে এরকম অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য থাকার পরও দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক মামলা করতে অনীহা প্রকাশ করেছে। দুদক বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হবে। দুদকের এ বক্তব্য সত্যিই হাস্যকর। সংবাদ সম্মেলনে সাবেক বিচারপতি ও সুজনের নির্বাহী কমিটির সদস্য গাজী এবায়েদুল হক, অজয় রায় বক্তব্য রাখেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতা
৫৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে ৯৩ জনই স্বল্পশিক্ষিত। এর হার ১৭.২২ ভাগ। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি বা তার চেয়ে কম। এছাড়া, ৫০ জন প্রার্থী এসএসসি’র গণ্ডিই পার হননি। তবে ৭০.৭৪ (৩৮২ জন) ভাগ প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা ১৫৩ জন প্রার্থীর মধ্যে এই হার ৮২.৩৫% (১২৬ জন) এবং ১৪৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৩৮৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ৬৬.১৪% (২৫৬ জন)।
প্রার্থীদের পেশা
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি প্রার্থী ব্যবসায়ী। এই হার শতকরা ৫২.২২ ভাগ বা ২৮২ জন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ ১৫৩ জন প্রার্থীর মধ্যে এই হার ৫২.৯৪% (৮১ জন) এবং ১৪৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৩৮৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ৫১.৯৪% (২০১ জন)। কিছু কিছু প্রার্থী একাধিক পেশা থেকে আয় করলেও নির্দিষ্ট ঘরে একটি পেশার কথা উল্লেখ করেছেন। সর্বমোট ২৫ জন (৪.৬২%) প্রার্থী একাধিক পেশার কথা উল্লেখ করেছেন।
মামলা
অতীতে সংসদ সদস্যদের অনেকের নামে অধিক মামলা থাকলেও এবার তাদের মামলা কমে গেছে। তবে এর মধ্যে ১২ জনের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় (হত্যা) মামলা রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩৫.৯২ ভাগ বা ১৯৪ জন প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও এবারের নির্বাচনে সে সংখ্যা মাত্র ১০.৯২ ভাগ বা ৫৯। অতীত ও বর্তমানে উভয় সময়ে মামলা ছিল বা রয়েছে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ২৯ (৫.৩৭%)। বর্তমানে ৪৮১ জন (৮৯.০৭%) প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা নেই এবং অতীতে ৩৪৬ জন (৬৪.০৭%) প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা ছিল না।
প্রার্থী ও নির্ভরশীলদের বাৎসরিক আয়
৫৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে বাৎসরিক ২ লাখ টাকা বা তার চেয়ে কম আয় করেন ৫৮ জন (১০.৭৪%) প্রার্থী। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ ১৫৩ জন প্রার্থীর মধ্যে এই হার ১.৩০% (২ জন) এবং ১৪৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৩৮৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৪.৪৭% (৫৬ জন)। ৫৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে বাৎসরিক ১ কোটি টাকার বেশি আয় করেন ৬০ জন (১১.১১%) প্রার্থী। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ ১৫৩ জন প্রার্থীর মধ্যে এই সংখ্যা ২৮ (১৮.৩০%) এবং ১৪৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৩৮৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩২ (৮.২৭%)। বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, সর্বোচ্চ ৩১.৬৭% (১৭১ জন) প্রার্থীর বাৎসরিক আয়সীমা ৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা।
প্রার্থী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ
৫৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে বেশির ভাগের (২৭৭ জন বা ৫১.২৯%) সম্পদ কোটি টাকার উপরে। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ ১৫৩ জন প্রার্থীর মধ্যে এই হার ৭৫.১৬% (১১৫ জন) এবং ১৪৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৩৮৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ৪১.৮৬% (১৬২ জন)। ৫৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে ৫ কোটি টাকার বেশি সম্পদের অধিকারী ১০৩ জন (১৯.০৭%) প্রার্থী। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ ১৫৩ জন প্রার্থীর মধ্যে এই সংখ্যা ৫৫ (৩৫.৯৪%) এবং ১৪৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৩৮৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ৪৮ জন (১২.৪০%)। অনেক প্রার্থীই সম্পদের মূল্য উল্লেখ না করায় আর্থিক মূল্যে সম্পদের প্রকৃত পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। অপরদিকে বর্তমান বাজারমূল্য উল্লেখ না করার কারণেও সম্পদের প্রকৃত পরিমাণ নিরূপণ করা যায়নি।
দায়-দেনা ও ঋণ
৫৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে ২২৬ জন (৪১.৮৫%) ঋণগ্রহীতা। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ ১৫৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ঋণগ্রহীতা ৮৯ জন (৫৮.১৬%) এবং ১৪৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৩৮৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ঋণগ্রহীতা ১৩৭ জন (৩৫.৪০%)। বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, ৫৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩১৪ জনেরই (৫৮.১৪%) কোন ঋণ নেই। ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষমতা সংশ্লিষ্টরা তুলনামূলকভাবে এগিয়ে (৫৮.১৬%)। ৫ কোটি টাকার অধিক ঋণ গ্রহণকারী প্রার্থীর সংখ্যা ৩৯ (৭.২২%)।
আয়কর প্রদান সংক্রান্ত তথ্য
৫৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে আয়কর প্রদানকারীর হার ৫০.১৮% (২৭১ জন)। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ ১৫৩ জন প্রার্থীর মধ্যে এই হার ৬৪.৭০% (৯৯ জন) এবং ১৪৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৩৮৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ৪৪.৪৪% (১৭২ জন)। ৮৬ জন প্রার্থীর আয়কর সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র পাওয়া গেলেও আয়কর প্রদান সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া না যাওয়ায় এগুলো দেখানো সম্ভব হলো না। ১০ লাখ টাকা অধিক আয়কর প্রদানকারী প্রার্থীর সংখ্যা ৪৮ জন (৮.৮৯%)। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ প্রার্থীদের মধ্যে আয়কর প্রদানের হার বেশি।
http://mzamin.com/details.php?mzamin=NTQ5MQ==&s=Mg==
No comments:
Post a Comment