কারণ দুই নেত্রীর এই টেলি সংলাপের ওপরই নির্ভর করছিল দেশবাসীর ভবিষ্যৎ। নির্ভর করছিল দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সাধারণ নির্বাচন আগামীতে হবে কি না। শুক্রবার ২৫ অক্টোবরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ১৮ দলীয় জোটের জনসভায় খালেদা জিয়া আহূত দেশ জুড়ে একটানা ৬০ ঘণ্টার হরতাল শুরু হয়ে যায় রোববার ২৭ অক্টোবর থেকে।
দেশবাসীর তীব্র কৌতূহল মেটাতে সোমবার ২৮ অক্টোবর হরতালের দ্বিতীয় দিনে প্রথম আলো-র ফ্রন্ট পেইজে ‘তিক্ত কথাও হয়েছে দুই নেত্রীর’ শিরোনামে সেকেন্ড লিড করে। কিন্তু এটা টেলি সংলাপের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট ছিল না। এই দিনই তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, টেলি সংলাপটি প্রকাশিত হওয়া উচিত। ধারণা করা হয়, প্রথম আলো আইন বহির্ভূতভাবে সংলাপের খণ্ডিত অংশটি হয়তো তথ্যমন্ত্রীর পূর্ব অনুমতি নিয়েই করেছে।
প্রথম আলোর এই আইন বহির্ভূত, কিন্তু অগ্রণী, ভূমিকায় সাহসী হয় মানবজমিন। মঙ্গলবার ২৯ অক্টোবর হরতালের তৃতীয় দিনে মানবজমিন পুরো এক পৃষ্ঠা জুড়ে টেলিসংলাপের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো প্রকাশ করে। তবে এটিও পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট ছিল না। মানবজমিনের এই রিপোর্টে দেশ তোলপাড় হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে সোমবার দিবাগত রাতে অর্থাৎ মঙ্গলবার ২৯ অক্টোবর রাত দুইটা থেকে সরকার সমর্থক একাত্তর টেলিভিশন থেকে ওই টেলি সংলাপের পুরোটাই সম্প্রচার শুরু হয়ে যায়।
এরপর যা হবার তাই হয়।
মঙ্গলবার ২৯ অক্টোবর প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলে পূর্ণাঙ্গ অথবা খণ্ডিতভাবে টেলি সংলাপ সম্প্রচারিত হতে থাকে। এই দিন দেশ জুড়ে আলোচিত হতে থাকে আওয়ামী লীগ সরকার কেন এই সংলাপ প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিল? এই সংলাপ প্রকাশের ফলে কোন দলের লাভ হলো? আওয়ামী লীগের নাকি বিএনপির? কোন নেত্রীর ক্ষতি হলো? শেখ হাসিনার নাকি খালেদা জিয়ার? কোন দলের নেতাদের কি প্রতিক্রিয়া হলো? সাধারণ মানুষ সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে কিভাবে নিল?
এ সবের মধ্যেই কেটে গেল ২৯ অক্টোবর ২০১৩ হরতালের তৃতীয় দিন। টানা ৬০ ঘণ্টার এই হরতালে নিহত হন ১৩ জন। আহত হন হাজারের বেশি এবং এদের মধ্যে ছিলেন পুলিশ, সাংবাদিক ও টিভি ক্যামেরাম্যান।
এই তিন দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমনটা ভয় করে হরতাল তুলে নেয়ার জন্য বারবার খালেদাকে অনুরোধ করেছিলেন, ঠিক তেমনটাই ঘটে যায় দেশ জুড়ে।
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় সর্বাত্মকভাবে হরতাল পালিত হয়। তবে রাজধানী ঢাকার চেয়ে মফস্বল শহরগুলোতে হরতালের তীব্রতা ছিল অনেক বেশি। ঢাকার হরতালও গত পাচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠোর ছিল। রাজধানীতে প্রাইভেট কার চলাচল ছিল না। বাস চলাচল ছিল খুব কম। অধিকাংশ দোকানপাট ছিল বন্ধ। স্কুল-কলেজ ছিল বন্ধ। ঢাকা ছিল ফাকা। সারা দেশ জুড়ে গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। বাস ডিপোতে আগুন ধরানো হয়েছে। বাস পুড়েছে। মোটরসাইকেল পুড়েছে। পথে পথে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। রেল লাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। মফস্বলে গাছের গুড়ি কেটে পথে ফেলা হয়েছে। আন্তজেলা চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
উত্তর বাংলাদেশে বিএনপি নেতা আসাদুল হাবিব দুলু প্রভাবিত লালমনিরহাটে প্রায় দশ হাজার মানুষ তীর-ধনুক, বল্লম, দা-কুড়াল হাতে জমায়েত হয়। শিফট ডিউটি করে তারা চব্বিশ ঘণ্টা জেগে থাকে। ভয়ে পুলিশ তাদের বাধা দেয়নি।
কাছাকাছি এলাকায় বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট আবু বকর সিদ্দিক প্রভাবিত কুড়িগ্রামের রৌমারি উপজেলার দাতভাঙ্গা ইউনিয়নে পুলিশ-বিজিবিকে ঘেরাও করে রাখে কয়েক হাজার গ্রামবাসী। তবে তিন দিন ঘেরাওয়ের মধ্যে তাদের নিয়মিত খাবার ও পানি দেয় গ্রামবাসী। এখানে বিজিবি-র তিনটি প্লাটুন এসে পৌছালেও তারা গুলি চালাতে সাহস পায়নি। তারা কুড়িগ্রামের জননেতাদের সঙ্গে আলোচনা চালান। সমঝোতা হয় যে, ওই এলাকার কারো বিরুদ্ধে মামলা হবে না। তখন ঘেরাও তুলে নেয়া হয়।
মফস্বলে এ ধরনের বহু ঘটনার ফলে সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মচারিদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অভাব সৃষ্টি হয়। এক দিকে কিছু পুলিশ যেমন অতি সক্রিয় থেকেছে, অন্য দিকে কিছু পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকতে চেয়েছে। কেউ বা পালিয়ে গিয়েছে। কেউ বা ছুটি নিতে চেয়েছে। শেখ হাসিনার কথিত কুমির বাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন অস্থিরতার গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।
টানা হরতালের ফলে বিভিন্ন নিরাপত্তাবাহিনীর মধ্যে গভীর ভীতি, চরম দুর্বলতা ও তীব্র অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লে তাদের চেইন অফ কমান্ড ভেঙে যেতে পারে এবং তার ফলে তাদের ওপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার ভাঙন শুরু হবে এই আশঙ্কাতে শেখ হাসিনা অনুরোধ করেছিলেন হরতাল তুলে নিতে।
শেখ হাসিনার আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে। আন্দোলন দমন সম্ভব হয়নি। ট্যাকটিকালি এটা সম্ভবও ছিল না। কারণ একদিকে প্রধানমন্ত্রী যখন আলোচনা ও শান্তির কথা বলছেন তখন তার পক্ষে সংঘর্ষ ও অশান্তির দিকে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিরোধী জোটের চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে হতাহতের সংখ্যা হয়েছে কম। ভবিষ্যতে আন্দোলনে হতাহতের সংখ্যা হবে বেশি। কারণ, তখন সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করবে।
বুধবার ৩০ অক্টোবরে প্রায় সব দৈনিক পত্রিকা দুই নেত্রীর টেলি সংলাপ প্রকাশ করে। তবে সাধারণ পাঠক এখানে হোচট খেয়েছেন। কারণ, কোনো পত্রিকাই সংলাপের সঠিক পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেনি। তারা নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে সংলাপের অসম্পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেছে। যদিও তাদের কেউ কেউ, যেমন প্রথম আলো দাবি করেছে হুবহু বিবরণ প্রকাশ করা হলো।
বুধবার ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যায় সম্পাদক শামীম তার রুমে সহকর্মীদের ডেকে বৃফিং দিচ্ছিল। উপস্থিত ছিল নিউজ এডিটর মেরি, অ্যাসিসট্যান্ট এডিটর শরিফ চৌধুরী, চিফ রিপোর্টার ফয়েজ আনসারি এবং আর্টিস্ট মহসিন আহমেদ।
যারা টিভিতে অথবা ইন্টারনেটে এই টেলি সংলাপ শুনেছেন তারা জানবেন হাসিনা-খালেদা কি বলেছিলেন। কিন্তু পত্রিকা পড়ে সেটা তারা জানবেন না। পত্রিকাগুলোর এই ব্যর্থতার একটা কারণ হতে পারে ইচ্ছাকৃত। অন্যান্য কারণ হতে পারে রেকর্ডিংয়ে ওভারল্যাপিং কথাবার্তা অর্থাৎ একজন কথা বলার সময় অপরজনও কথা বলছিলেন। আর একটি কারণ হতে পারে রেকর্ডিংয়ে কিছু অংশে অস্পষ্টতা। তাই শুকতারায় পূর্ণ বিবরণটা প্রকাশ করা উচিত। মেরি বলল।
কিন্তু গতকাল বিভিন্ন পত্রিকাতে তো প্রায় পুরো সংলাপই প্রকাশিত হয়েছে। আমরাও তো দেখেছি। তাহলে আমরা নতুন কি দেব পাঠকদের? চিফ রিপোর্টার ফয়েজ জানতে চাইল।
আমরা টেলি সংলাপের বিভিন্ন অংশের বিশ্লেষণ দেব। মতামত দেব। হাসিনা-খালেদা আরো যা বলতে পারতেন সেটা অনুমান করব। এ সবই ছাপব। সংলাপটা কমপিউটারে অন করো। আমাদের বিশ্লেষণে যে রেটিং দেব সেটা কৃকেটের পরিভাষায় দেব। নিউ ইয়র্ক নিবাসী কলামিস্ট মোহাইমেন জায়গীরদারকে ফলো করব। তিনি অতীতে কৃকেটার ছিলেন। এখন টাইমস স্কোয়ারে বম্বে মসালা নামে একটি সফল রেস্টুরেন্ট চালান। তুমি নোট করতে থাকো। শামীম নির্দেশ দিল শরিফকে।
কমপিউটারে শুরু হলো সংলাপ।
শরিফ নোট, প্যাড ও বলপয়েন্ট নিয়ে রেডি হলো।
সøামালাইকুম
জি, এডিসি সাহেব।
হ্যা, শিমূলদা, আপনি তো ফোন দিলেন না।
না, না। আমরা তো অপেক্ষা করছি আপনার জন্য। ছয়টা থেকে ম্যাডাম বসে রয়েছেন।
না, না। আপনাদের তো কল করার কথা।
না। এ রকম কোনো কথা তো আপনার সঙ্গে আমার হয়নি। আপনি ছয়টায় ফোন দেবেন। ম্যাডামকে আমি আধা ঘণ্টা ধরে বসিয়ে রেখেছি।
আমি আপনাকে বলিনি যে আমি ফোন দেব। বিকজ আমরা এক্সপেক্ট করছি আপনারা ফোন দেবেন।
না, আপনি উল্টা কথা বলছেন। এ ধরনের কোনো কথা হয়নি। আমি ম্যাডামকে বলেছি ...
না, আমিও তো বলিনি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফোন দেবেন। আমি বলেছি ...
আপনি টেলিফোন করে মিলিয়ে দেবেন। এটা আপনার ডিউটি যে আপনি টেলিফোন করিয়ে মিলিয়ে দেবেন। ম্যাডাম এখন পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন।
আমরা অপেক্ষা করছি আপনার কলের জন্য।
ম্যাডাম এখনো বসে আছেন। আপনি দেন, এখনই দেন। ম্যাডামকে দিচ্ছি আমি।
আছেন ওখানে আপনারা?
জি, জি। ম্যাডাম এখনো আছেন।
আচ্ছা ওয়েট করেন।
ম্যাচ ওপেনিংয়ের আগে পিচ পরীক্ষাতেই দুই দলের মধ্যে মতানৈক্য দেখা গেল। এখানে শিমূল বিশ্বাস জিতলেন। কারণ দেশবাসী জানত ফোন কল আসবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। রোববার ২০ অক্টোবরে দুপুরে ক্যাবিনেট মিটিংয়ের পর শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল সেদিনই তিনি খালেদা জিয়াকে ফোনের চেষ্টা করেছিলেন। এরপরে শুক্রবার ২৫ অক্টোবর বিকেলের জনসভায় খালেদা জিয়া সরকারকে প্রস্তাব দিতে বলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চিঠিও দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর এডিসি যখন শনিবার ২৬ অক্টোবরে ফোন করেন তখন বল সরকারের হাতে ছিল।
খালেদা জিয়া : হ্যালো, হ্যালো।
শেখ হাসিনা : হ্যালো, সøামালাইকুম, কেমন আছেন?
খালেদা জিয়া : আমি আছি, ভালো আছি।
শেখ হাসিনা : আমি ফোন করেছিলাম আপনাকে দুপুর বেলা, পাইনি।
খালেদা : দেখেন, এই কথাটা যে বলছেন, তা সঠিক নয়।
হাসিনা : আমি আপনাকে জানিয়ে দিতে চাই ...
খালেদা : আপনাকে প্রথমে আমার কথা শুনতে হবে। আপনি যে বলছেন দুপুরে ফোন করেছিলেন, দুপুরে কোনো ফোন আসেনি। এই কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। দুপুরে কোনো ফোন আসেনি আমার এখানে।
হাসিনা : আমি রেড ফোনে ফোন দিয়েছিলাম।
খালেদা : রেড ফোন তো দীর্ঘদিন ধরে, বছর ধরে, ডেড পড়ে আছে। আপনারা গভর্নমেন্ট চালান, কি খবর রাখেন? গভর্নমেন্ট চালাচ্ছেন, এই খবর রাখেন না যে বিরোধীদলীয় নেতার ফোন ঠিক আছে কি না। আর আপনি যদি ফোন করবেনই, তাহলে গতকালই আপনার লোক এসে ফোন ঠিক করে দেওয়া উচিত ছিল। দেখে যাওয়া উচিত ছিল যে বিরোধীদলীয় নেতার ফোন ঠিক আছে কি না।
হাসিনা : রেড ফোন সব সময় ঠিক থাকে।
খালেদা : আপনারা লোক পাঠান। এখনই লোক পাঠান। দেখে যান ফোন ঠিক আছে কি না।
হাসিনা : আপনি তো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আপনি জানেন, রেড ফোন সব সময় ভালো থাকে।
খালেদা : ভালো থাকে তো, তবে আমারটা ভালো নেই। আমারটা তো ভালো নেই।
হাসিনা : ভালো আছে, আমি যখন ফোন করেছিলাম, সেটা ভালো ছিল।
খালেদা : না, সেদিনও চেক করেছি। আপনারা যদি সত্যি কথা না বলেন, তাহলে চলবে না।
হাসিনা : আমার সত্যি কথা না বলার তো কিছু নেই। আমি কয়েকবার ফোন দিয়েছি।
খালেদা : হঠাৎ করে কি মৃত ফোন জেগে উঠবে? আপনার টেলিফোন এত পাওয়ারফুল যে ডেড ফোন জেগে উঠবে!
হাসিনা : ঠিক আছে, যেকোনো কারণেই আপনি ফোনটা ধরতে পারেন নাই।
খালেদা : না, ধরতে পারি নাই না। আমি এখানে বসা। আমি এর মধ্যেই ঘুরি। ছোট্ট জায়গা, ছোট্ট জায়গার মধ্যেই আমি ঘুরি। এই ফোন বাজলে আমি না ধরার কোনো কারণ থাকতে পারে না। ডেড ফোন বাজতে পারে না। বুঝেছেন? এটাই হলো সত্যি কথা।
হাসিনা : দেখুন, ডেড ছিল, না ডেড করে রাখা হয়েছে ...
খালেদা : ডেড ছিল। বহু কমপ্লেইন আপনাদের কাছে গেছে। কিন্তু আপনারা তো ... রেড ফোনে আমার সাথে কথা বলার লোক নেই। কাজেই আমি কার সাথে কথা বলব?
হাসিনা : আমি আগামীকাল দেখব, কেন আপনার ফোন এ রকম ডেড ছিল।
খালেদা : সে তো দেখবেন, ভালো কথা।
কৃকেটপ্রেমীরা জানেন ফার্স্ট ওভারটি কত ইম্পরটেন্ট। ফার্স্ট ওভারেই যদি বোলার একটা উইকেট নিতে পারেন তাহলে তার দলের আধিপত্যের সূচনা হয়। অন্য দিকে ফার্স্ট ওভারে যদি ওপেনিং ব্যাটসম্যান রান করতে পারেন তাহলে তার দলের আধিপত্যের সূচনা হয়। বাউন্ডারি হাকালে তো কথাই নেই। ওভার বাউন্ডারি বা ছক্কা মারলে তো সুপার-ডুপার।
দেখা যাচ্ছে ফার্স্ট ওভারের ফার্স্ট বলেই হাসিনা নো-বোল করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি ফোন করেছিলাম আপনাকে দুপুর বেলা। পাইনি।’
এর উত্তরে খালেদা বলেননি যে হাসিনা মিথ্যা বলছেন। খালেদা বলেন ভদ্রভাবে, কথাটা সঠিক নয়। এখানে খালেদার সংযম প্রশংসনীয়। বিরক্তিকর এবং টেনশনপূর্ণ প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর খালেদা এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তত ছিলেন না। সংলাপের কমান্ড ও কনট্রোল তিনি তখনই নিয়ে নিতে মনস্থির করেন। তাই তিনি কমান্ডিং টোনে বলেন, ‘আপনাকে প্রথমে আমার কথা শুনতে হবে। আপনি যে বলছেন দুপুরে ফোন করেছিলেন, দুপুরে কোনো ফোন আসেনি। এই কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। দুপুরে কোনো ফোন আসেনি আমার এখানে।’
একটা ছক্কা মারলেন খালেদা।
এরপর যখন হাসিনা বলেন, ‘আমি রেড ফোনে ফোন দিয়েছিলাম’ তখন খালেদ টোটাল কমান্ড নিতে এগিয়ে যান।
খালেদা বলেন, ‘রেড ফোন তো দীর্ঘদিন ধরে, বছর ধরে, ডেড পড়ে আছে। আপনারা গভর্নমেন্ট চালান কি খবর রাখেন? গভর্নমেন্ট চালাচ্ছেন, এই খবর রাখেন না যে বিরোধীদলীয় নেতার ফোন ঠিক আছে কি না। আর ... গতকালই আপনার লোক এসে ফোন ঠিক করে দেয়া উচিত ছিল। দেখে যাওয়া উচিত ছিল যে, বিরোধীদলীয় নেতার ফোন ঠিক আছে কি না।’
খালেদা আরেকটি ছক্কা মারলেন।
খালেদা জিয়া তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তার প্রথম মেয়াদের শাসনকাল এখনো দেশের সবচেয়ে ভালো এবং গণতান্ত্রিক সময় রূপে পরিচিত হয়ে আছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা তুলেছেন। হাসিনা এর সদুত্তর দিতে পারেননি। খালেদা এখানে আরো বলতে পারতেন, এ জন্যই প্রধানমন্ত্রী হাসিনা জানেন না কুইক রেন্টাল সত্ত্বেও কতবার লোড শেডিং হচ্ছে, সরকারি ব্যাংকগুলো কিভাবে লুটপাট হচ্ছে, দেশে খুন-রাহাজানি-ছিনতাই কত বেশি হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম কিভাবে বাড়ছে।
এরপর খালেদা আদেশ দেন হাসিনাকে, ‘আপনার লোক পাঠান। এখনই লোক পাঠান। দেখে যান ফোন ঠিক আছে কি না।’
খালেদা দুই রান করলেন।
হাসিনাকে তিনি অর্ডার দিলেন, যে অর্ডারটি পরে হাসিনা পালন করতে বাধ্য হন।
হাসিনা তবু বলেন, ‘রেড ফোন সব সময় ভালো থাকে।’
প্রতি উত্তরে খালেদা বলেন, ‘আপনারা যদি সত্যি কথা না বলেন, তাহলে চলবে না।’
লক্ষণীয় যে, খালেদা কখনোই বলছেন না, হাসিনা মিথ্যা বলছেন। অর্থাৎ, প্রচণ্ড বিরক্তি সত্ত্বেও খালেদা তার ভাষায় সংযম রক্ষা করে চলছেন।
কিন্তু তারপরও যখন হাসিনা ডেড ফোন প্রসঙ্গটা লাইভ রাখেন, তখন খালেদা সারকাজম (Sarcasm)-এ বা শ্লেষাত্মক ভাষায় চলে যান। খালেদা বলেন, ‘হঠাৎ করে কি মৃত ফোন জেগে উঠবে? আপনার টেলিফোন এত পাওয়ারফুল যে ডেড টেলিফোন জেগে উঠবে? ... ডেড ফোন বাজতে পারে না। বুঝছেন? এটাই হলো সত্যি কথা।’ খালেদা এর পরেও কিছু শ্লেষাত্মক বাক্য প্রয়োগ করেছেন।
সুপার ব্যাটিং। আরেকটা ছক্কা।
এরপর হাসিনা একটা লুজ (Loose) বা ঢিলা বল করেন। তিনি বলেন, ‘দেখুন, ডেড ছিল, না ডেড করে রাখা হয়েছে ...’
খালেদা বলেন, ‘ডেড ছিল। বহু কমপ্লেইন আপনাদের কাছে গেছে ...’
হাসিনা বলেন, ‘আমি আগামীকাল দেখব, কেন আপনার ফোন এ রকম ডেড ছিল।’
ফার্স্ট ওভারে আলোচ্য বিষয় ছিল ডেড রেড টেলিফোন। ফোন করা বিষয়ে হাসিনার অসত্য বলার কারণ ছিল। তিনি চেয়েছিলেন শনিবার ২৬ অক্টোবরের শেষ মুহূর্তে ফোন করতে। ফোন রিসিভ করা বিষয়ে খালেদার অসত্য বলার কোনো কারণ ছিল না। তিনি যদি ফোন রিসিভ না করতে চাইতেন তাহলে শনিবার ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকতেন না এবং ছ’টা একুশের কলও রিসিভ করতেন না। তার জন্য এই কল ছিল খুবই ইমপরটেন্ট। কারণ, এরই ওপরে নির্ভর করছিল আগামী আন্দোলনের কর্মসূচি।
হাসিনা যে আন্তরিক ছিলেন না সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রোববার ২০ অক্টোবরে যেদিন পেশাজীবী সম্মেলনে চায়না-বাংলা মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে খালেদার যাওয়ার কথা ছিল সেদিন সকাল থেকে পুলিশ পাহারা দিচ্ছিল খালেদার বাসভবনের সামনে। ২৬ অক্টোবর শনিবার সকাল অথবা দুপুরে শেখ হাসিনার সদিচ্ছা থাকলে কোনো পুলিশ অফিসারকে খালেদার বাসভবনে পাঠিয়ে মেসেজ দিতে পারতেন। টি অ্যান্ড টিতে খোজ নিতে পারতেন। অথবা মোবাইল ফোনে খালেদার কোনো স্টাফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন। সেটা তিনি করেননি।
এখানে লক্ষণীয় খালেদা কখনো বলেননি, আপনিই (হাসিনা) আমার লাইন কেটে দেয়ার অর্ডার দিয়েছেন। যেমনটা আপনার ইঙ্গিতেই বিচার বিভাগের যোগসাজশে আমার বাড়ি থেকে আমাকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। যেমনটা এসএসএফ-এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। যেমনটা, সরকারি গাড়ি প্রত্যাহার করা হয়েছিল। যেমনটা, আমার বর্তমান গুলশানের ভাড়া বাড়ি থেকে উচ্ছেদের প্ল্যান করা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে রেড টেলিফোন ডেড করে দেয়াটা এমন আর কি?
আরো লক্ষণীয় যে, অচল টেলিফোন বিষয়ে সাধারণত মানুষ বলে থাকে, লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে, লাইন কাটা আছে, ইত্যাদি। কিন্তু খালেদা ‘লাইন কাটা’ বাক্যটি প্রয়োগ করেননি।
সেকেন্ড ওভারে আলোচ্য বিষয় ছিল রোববার ২৭ অক্টোবর থেকে ডাকা ৬০ ঘণ্টা হরতাল তুলে নেয়া।
হাসিনা : আমি আপনাকে ফোন করলাম। আগামী ২৮ তারিখে ... সন্ধ্যায় গণভবনে আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি। আপনি জানেন যে আমি ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি আগামী নির্বাচন সম্পর্কে। আমি আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি। ... গণভবনে আসার জন্য।
খালেদা : আপনার যদি সত্যিকারের আন্তরিকতা থাকে আলোচনা করার জন্য, আমার যেতে কোনো আপত্তি নেই। আমি একা যাব না। আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই আরো কেউ থাকবে।
হাসিনা : আপনি যতজন খুশি নিয়ে আসতে পারেন। সমস্যা নেই।
খালেদা : আমি দলবলসুদ্ধ নিয়ে যেতে চাই না। যাদের প্রয়োজন মনে করব, তাদের নিয়ে যাব। সেটা হতে হবে ২৮ তারিখের পরে। ২৯ তারিখ আমার হরতাল শেষ হওয়ার পরে।
হাসিনা : আমি অনুরোধ করব জাতির স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে হরতাল প্রত্যাহার করে নেন।
খালেদা : না। আমি ২৮ তারিখ যেতে পারব না।
হাসিনা : মানুষ খুন করা, আগুন মারা এসব বন্ধ করুন।
খালেদা : মানুষ খুন করা আপনাদের কাজ। আপনারা মানুষ জ্বালান, মানুষ মারেন, লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ মারেন। এসব রেকর্ডেড। আপনার নির্দেশে এবং আপনার মুখ দিয়েই এই শব্দ বেরিয়েছে। কাজেই এসব আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। আমি বলছি, হরতাল চলবে। ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় শেষ হবে। এরপর আলোচনা।
হাসিনা : আমি বলছি, দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে দয়া করে এই হরতাল প্রত্যাহার করুন।
খালেদা : না। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থেই আমি এই হরতাল দিয়েছি। যেহেতু আপনারা কোনো আলোচনায় আসতে রাজি নন। আপনার মন্ত্রীরা বলছেন, কোনো আলোচনা হবে না। আপনি নিজে বলেছেন। আমাদের প্রস্তাব রিজেক্ট করে দিয়েছেন। কোনো আলোচনার দরকার নেই, এটা আপনারা বলছেন। এখন আবার আলোচনার কথা বলছেন। সেই আলোচনা হতে পারে, আমাদের কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর।
হাসিনা : আমি আপনাকে অনুরোধ করছি ...
খালেদা : না। সেটা সম্ভব না। উদ্যোগটা যদি এক দিন আগে নিতেন, সেটা সম্ভব ছিল।
হাসিনা : এটা এক দিন আগের বিষয় না। আপনি জানেন, আমি বিভিন্ন দলের সঙ্গে বসছি ...
খালেদা : আমি জানি, আপনি ব্যস্ত মানুষ। আপনার মতো ব্যস্ত না হলেও আমাদেরও ব্যস্ততা আছে। ইচ্ছা করলে উপায় বের করা যায়। কিন্তু আপনারা সেটা করেননি। কালকে যে আমাদের সমাবেশের পারমিশন দিলেন, এত দেরিতে দিলেন কেন? কত দিন আগে পারমিশন চেয়েছি। মাইক পর্যন্ত লাগাতে দেন না। মানুষ এসে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথা শুনতে পারে না। এটা কোন দেশের গণতন্ত্রের নমুনা দেখছেন আপনি?
হাসিনা : আমি যে সবার সঙ্গে আলোচনা করব, তা কিন্তু বহুদিন আগেই সবাইকে ...
খালেদা : আমরা যে সমাবেশ করলাম, সেখানে মাইকের পারমিশন দেওয়া কেন হলো না?
হাসিনা : না, মাইক তো দেয়া হয়েছে। কয়েকটা মাইক ছিল।
খালেদা : না, আমরা যত দূর ইচ্ছা মাইক দেব। লোক বেশি শুনবে। লোক আসবে এ জন্য গাড়ি বন্ধ করে দেন, ১৪৪ ধারা জারি করেন। দেশে ইমার্জেন্সি চলছে নাকি? দেশে কি যুদ্ধাবস্থা চলছে যে এমন শুরু করে দিলেন আপনারা?
হাসিনা : আমি এ ব্যাপারে এখন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি না।
খালেদা : কথা বলতে না চাইলে তো কথাই নেই।
হাসিনা : কথাগুলো সত্য না। আপনারা তো মিটিং করছেন।
খালেদা : আপনারা মিটিং করতে দেবেন মাইক দেবেন না। এমন সময়ে পারমিশন দেবেন, যখন ডায়াসও বানাতে পারব না। আপনারা কি আগে মিটিং করেন নাই?
হাসিনা : সব মনে আছে। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা মনে আছে ...
খালেদা : গ্রেনেড হামলা আমরা করিনি, আপনারাই করেছেন।
হাসিনা : রাত ১১টায় পারমিশন দিয়েছেন, সেটাও মনে আছে। এসব কথা আপনাদের মুখে মানায় না।
খালেদা : মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ ছিল। সেখান থেকে যে ভেনু পরিবর্তন করে আপনাদের অফিসে নিয়ে গেছেন, সেটা পর্যন্ত আমাদের জানাননি। এসব পুরনো কথা বাদ দেন। এখন আপনাকে আমি বলছি, যদি সত্যিকারের আলোচনা করতে আন্তরিক হন, তাহলে আমাদের কর্মসূচির পরে ...
হাসিনা : আমরা নিশ্চয় ঝগড়া করতে চাই না।
খালেদা : আপনি তো ঝগড়া করছেনই।
হাসিনা : আপনি একতরফাই তো বলে যাচ্ছেন। আমাকে তো কথা বলারই সুযোগ দিচ্ছেন না।
খালেদা : আমি একতরফা বলব কেন। আপনি কথা বলছেন, আমি জবাব দিচ্ছি শুধু।
হাসিনা : আমি তো আপনার সঙ্গে কথা বলারই সুযোগ পাচ্ছি না।
খালেদা : আপনি বারবার বলছেন, হরতাল হরতাল। হরতাল এখন প্রত্যাহার হবে না। আমাদের কর্মসূচি শেষ হলে তারপর যদি ... আপনি জানেন। আপনি যদি ...
হাসিনা : হরতালের নামে মানুষ খুন করা অব্যাহত রাখবেন?
এখানে খালেদা ধরিয়ে দিয়েছেন ‘খুন’ শব্দটিতে হাসিনা অভ্যস্ত। এমনকি এই ফোন সংলাপে হাসিনাই প্রথম মানুষ খুন করা, আগুন মারা, প্রভৃতি বাক্য ব্যবহার করেছেন।
তৃতীয় ওভারে খুনের প্রতি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের আসক্তি আলোচিত হয়।
খালেদা : আমি মানুষ খুন করতে চাই না। আপনারা মানুষ খুন করছেন। কালকেও নয়জন মানুষ আমার খুন করেছেন আপনারা। ... আপনার ছাত্রলীগ, যুবলীগ করে না?
হাসিনা : না।
খালেদা : আপনার ছাত্রলীগ-যুবলীগের আমরা অস্ত্রসহ ছবি দেখাতে পারব। আপনার ছাত্রলীগ-যুবলীগ কিভাবে খুন করে নিরীহ মানুষকে।
হাসিনা : বললাম তো খুনের রাজনীতি আমরা করি না; বরং আমি দেখি ...
খালেদা : ... আপনাদের তো পুরনো অভ্যাস। আপনারা সেই স্বাধীনতার পর থেকে ’৭১-এ যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখনো এই হত্যা করেছেন। এত মানুষ হত্যা করেছেন। এগুলো ভুলে গেছেন আপনি?
হাসিনা : একাত্তরে আমরা মানুষ হত্যা করেছি?
খালেদা : হ্যা অবশ্যই, একাত্তরের পরে।
হাসিনা : যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য।
খালেদা : যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য নয়। আপনারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যদি ঠিকমতো করতেন তাহলে আমরা পূর্ণ সমর্থন দিতাম। কিন্তু আপনারা সেই ট্রাইব্যুনাল করেননি। না করে একতরফা করেছেন এবং আপনার দলে যে অনেক যুদ্ধাপরাধী আছে সেগুলো একটাও ধরেননি। সেগুলোকে একটাও কেন ধরেননি? আপনি তো প্রধানমন্ত্রী নন। দলের প্রধানমন্ত্রী। আপনি তো দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। নিরপেক্ষতার ঊর্ধ্বে আপনি যেতে পারেননি। নাহলে, আমার সঙ্গে এই আচরণ তো আপনারা করতেন না, যা করেছেন আপনারা। আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন, সেদিন আমার পার্টি অফিসে আপনারা যে আচরণ করলেন, এরপর আর বলতে হবে? বিরোধীদলীয় নেতাকে আপনারা সম্মান দিতে জানেন না। কিসের গণতন্ত্রের কথা বলেন আপনি?
এখানে স্বাধীনতার পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন আমলে মানুষ হত্যা বিষয়টি খালেদা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তবে শেখ মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধাবশত তিনি তার নাম উচ্চারণ করেননি Ñ যদিও হাসিনা সর্বদাই জিয়াউর রহমানের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন।
লক্ষণীয় যে, রক্ষী বাহিনীর নাম খালেদা করেননি। কথিত আছে, শেখ মুজিবের আমলে এই বাহিনীর হাতে অন্ততপক্ষে ত্রিশ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল।
আরো লক্ষণীয় যে, এখানে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষে অন্ততপক্ষে পনের লক্ষ মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি খালেদা বলেননি।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে যে দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে হাসিনা উঠতে পারেননি সেটাও দৃঢ়ভাবে বলে দিয়েছেন খালেদা। হাসিনার স্বৈরাচারী চরিত্রের উল্লেখ করেছেন সোমবার ২১ অক্টোবর নয়া পল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে ছাত্রদল নেতা টুকুর গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা নিয়ে। সেই রাতে এগারোটার সময়ে খালেদা গিয়েছিলেন অসুস্থ বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীকে দেখতে। ফেরার সময়ে খালেদার নিরাপত্তা স্টাফ, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মজিদকে হেনস্তা করে পুলিশ এবং টুকুকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। এ সবই ঘটে খালেদার চোখের সামনে। তবে তিনি সেখান থেকে সরে যাননি। বাকি সব নেতা-কর্মীকে নিরাপদে বাড়ি ফেরার সুযোগ করে দিয়ে সবশেষে তিনি নিজে গুলশানে ফিরে যান।
হাসিনার এই অগণতান্ত্রিক আচরণ তুলে ধরার জন্য দুই রান।
চতুর্থ ওভারটি ছিল অতীত নিয়ে।
খালেদা নিকট অতীতে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন, আমলে ফিরে যান। হাসিনা ফিরে যান আরো আগে।
হাসিনা : আপনার কথার জবাব দিতে গেলে আমাকে তো সেই ২০০১ থেকে অনেক কথা বলতে হবে।
খালেদা : সেটার জবাব আমিও দিতে পারি। আপনি দেবেন আমিও দিতে পারি ...
হাসিনা : ... এরশাদ বা তার দলের সাথে কি কি করেছিলেন। আর ২০০১ সালে ...
খালেদা : একাত্তর সালে আমরা কিছু করিনি। এরশাদের সময় যত করেছেন আপনারা। এরশাদ যখন একটি নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা নিল, তারপর আপনি বললেন, আই অ্যাম নট আনহ্যাপি। আপনি যখন বিবিসিকে বললেন, তারপরে আর কি থাকে? ... ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন কোন সংবিধানের অধীনে ক্ষমতা নিল ...
হাসিনা : ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন আপনার চয়েস ছিল।
খালেদা : ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন আমার চয়েস ছিল না। আপনার চয়েস ছিল। আপনি নিজে বলেছেন আমার আন্দোলনের ফসল। এগুলো ভুলে যান কেন? মানুষ তো ভুলে না সেগুলো।
হাসিনা : নয়জন অফিসার ডিঙিয়ে মইনউদ্দিনকে আপনি আর্মি চিফ বানিয়েছিলেন।
খালেদা : আপনি এমন অনেক অফিসারকে বাড়ি পাঠিয়েছেন। সেটা নয়জন না সাতজন, সেটা কথা নয়। আপনি অনেককে ডিঙিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছেন। মইনউদ্দিন যেই থাকুক না কেন, যখন এটা করল, সেখানে আপনারা ... সেই ইয়েতে (শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে) গেলেন কেন আপনি? সেটা সংবিধানসম্মত হয়নি। সংবিধানসম্মত ছিল না। সেটাতে কেন গেলেন আপনি? সেদিন তো আপনি মনে করেননি। আমরা দুই দলই তখন ক্ষমতার বাইরে ... তখন তো একবারও মনে করলেন না আমরা আলোচনা করি, ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। এরা সংবিধানসম্মত নয়। আপনি তো সেটা মনে করলেন না। চলে গেলেন সেখানে হাসিমুখে।
হাসিনা : ... আমি আগুনে বসেও পুষ্পের হাসি, হাসি। আমার বাবা, মা, ভাই ...
এখানে হাসিনা বিষয়টিকে হালকা করে ফেলেন। কিন্তু খালেদা তাকে মনে করিয়ে দেন এরশাদসহ সামরিক বাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে হাসিনার গভীর সম্পর্ক। খালেদা বলতে পারতেন, আপনার জন্য ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের সময়টা আগুন ছিল নাÑ সেটা আপনার জন্য ছিল ফুলের বাগান। তাই আপনি বলতে পারেন ফুলের হাসি হেসেছেন। প্যারোলে মুক্তি নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ে আপনার মুখে হাসিই ছিল। সেই সময়টা আগুন ছিল আমার জন্য এবং আমার দলের জন্য। আমি এক বছর জেলে থেকেছি।
হাসিনা ১৯৭৫Ñএ ফিরে যান। ছোট ভাই প্রসঙ্গের পরে তিনি তার বহুল ব্যবহৃত বাবা-মা’র প্রসঙ্গটি টেনে আনতে চান।
খালেদা : ... অতীত ছেড়ে দিয়ে আমি বলতে চাই এখন সামনের দিকে কি করে আগাবেন ... আপনার যদি সত্যি সৎ উদ্দেশ্য থাকে তাহলে আমরা সামনের দিকে কি করে এগোবো ... সামনের দিকে এগোতে চাই।
হাসিনা : আপনি তো অনেক অভিযোগ করলেন। আমি তো এত অভিযোগ করতে চাই না। ছোট্ট রাসেল ..., ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছেন।
খালেদা : দেখেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা আপনারা করিয়েছেন। আপনাকে হত্যা করতে কেউ চায়নি। ... আপনি যত থাকবেন, তত আমাদের জন্য ভালো। ... আপনি যত এ রকম অশ্লীল ভাষায় কথা বলবেন, তত আমাদের জন্য ভালো।
হাসিনা : ১৫ আগস্ট আপনি যখন কেক কাটেন...
খালেদা : ১৫ আগস্ট আমার জন্মদিন। আমি কেক কাটবই।
হাসিনা : খুনিদের উৎসাহিত করার জন্য যখন আপনি কেক কাটেন। ...
খালেদা : ... এটা বলবেন না। ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে কোনো মানুষের জন্ম হবে না? কোনো মানুষ পালন করবে না? এগুলো বাদ দেন। কথায় কথায় আপনারা বলেন। অনেক কথা বলেন জিয়াউর রহমানকে। আরে, জিয়াউর রহমান তো আপনাদের নতুন জীবন দান করেছেন। এগুলো কথা বলবেন না। বুঝেছেন! আপনারা তো বাকশাল ছিলেন। ... আপনারা জিয়াউর রহমানের বদৌলতে আওয়ামী লীগ হতে পেরেছেন। আদারওয়াইজ আওয়ামী লীগ হতে পারতেন না।
হাসিনা : ... রাসেলকে তো এই বাসায় ঘুরতেও দেখেছেন ...
এখানে শেখ হাসিনার ভাষা সম্পর্কে বহুল প্রচলিত কথাটি তাকে শুনিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়া। অন্যদিকে শেখ হাসিনা শুনিয়ে দিয়েছেন ১৫ আগস্টে খালেদার জন্মদিনে কেক কাটার বিষয়টি। খালেদা দৃঢ়ভাবে নিজেকে ডিফেন্ড করে ব্যাট করেছেন। নিজের জন্মদিনের প্রসঙ্গ ওঠার সুযোগে তিনি আজকের আওয়ামী লীগের জন্মদাতা হিসেবে জিয়াউর রহমানকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সিম্পলি বৃলিয়ান্ট। চার রান।
লক্ষণীয় যে, জিয়াউর রহমানের নাম ভাঙিয়ে খালেদা কোনো করুণা বা দয়াভিক্ষা করেননি। খালেদা মনে করিয়ে দেননি যে হাসিনার প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীত্বের সূচনাতেই জিয়ার মাজারে যাওয়ার বেইলি বৃজটি মিথ্যা অজুহাতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কবরে জিয়ার লাশ আছে কিনা সেই সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনা প্রায়ই তার প্রয়াত আত্মীয়-স্বজনের কথা বলে সহানুভূতি আদায় করতে চান।
তার এই শোক-ভিত্তিক রাজনীতি খালেদা কখনোই অনুসরণ করেননি। এমনকি এই ফোন সংলাপেও নয়।
অথচ হাসিনা নিহত ভাই রাসেল-এর উল্লেখ করেন। খালেদা আবারও তাকে সামনের দিকে এগোতে বলেন। চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় হাসিনার অতীতমুখিতা এবং খালেদার ভবিষ্যতমুখিতা।
খালেদা : নতুন করে শুরু করি। সেটাতে আপনি রাজি থাকেন, আসেন আমরা সুন্দর আলোচনা করি। আমার আলোচনা করতে আপত্তি নাই। কিন্তু সেই ডেট হতে হবে আমার হরতাল শেষ হওয়ার পর।
হাসিনা : আপনার হরতাল প্রত্যাহার করবেন না?
খালেদা : না, আমি হরতাল প্রত্যাহার করতে পারব না। এটা তো আমার ডিসিশন না। এটা ১৮ দলের ডিসিশন। আমি এটা কি করে একলা করব?
হাসিনা : আপনি ১৮ দলকে ডেকে নিয়ে বলেন ...
খালেদা : এখন সময় নাই। আপনি যে তাড়া করছেন। এখন তো খুজে পাওয়া যাবে না লোকজনকে। আপনি তো সবার পেছনে পুলিশ লাগিয়ে রেখেছেন। কি করে মানুষ পাওয়া যাবে, বলেন?
হাসিনা : আমরা পুলিশ লাগিয়ে রাখব কেন?
খালেদা : আপনি লাগিয়ে রাখবেন না তো কে রাখবে? পুলিশ ... কার কথায় ... আমার কথায় চলে? আপনি তো সবার বাসায় বাসায় রেইড করছেন। বস্তি থেকে পর্যন্ত আপনি লোক ধরে নিয়ে যাচ্ছেন।
হাসিনা : যেখানে বোমা ব্লাস্ট হয়ে যাবে ...
খালেদা : বোমা ব্লাস্ট হয়ে যাবে! বোমা ব্লাস্ট তো আপনারা করেন আর নাম দেন আমাদের। এগুলো তো আপনাদের পুরাতন ঐতিহ্য। আমি বলতে চাই, যদি আপনারা ২৯ তারিখের পরে করেন আমি রাজি আছি। আমি নিশ্চয় কথা বলতে রাজি আছি।
হাসিনা : আপনি আলটিমেটাম দিলেন দুই দিনের। আমি দুই দিনের মধ্যেই ফোন করলাম। অথচ এখন হরতালও করবেন আবার বলছেন ২৯ তারিখের পরে। আপনি কি বক্তৃতা দিলেন আর আজকে এখন কি বলছেন, আপনি একটু ভেবে দেখেন।
খালেদা : আমি বলেছি আলোচনা চলুক, কর্মসূচিও চলবে।
খালেদা যে দূরদর্শী সেটা প্রমাণিত হয় এখানে। শুক্রবার ২৫ অক্টোবরে জনসভায় তিনি যুগপৎ আলোচনা এবং কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। তাই হাসিনা একটা ফাস্ট বোল করলেও খালেদা সেটা রুখে দিতে পারেন। শেখ হাসিনা তার সংলাপে কয়েকবার বলেছেন তিনি খালেদা জিয়ার বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই ফোন করেছেন। তার এ কথা ঠিক নয়। কারণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খালেদা শুক্রবার বিকাল সোয়া পাচটায় তার ভাষণ শেষ করেন। শনিবার বিকাল পাচটায় খালেদার বেধে দেয়া সময়সীমা শেষ হয়ে যায়। হাসিনা ফোন করেন শনিবার সন্ধ্যা ছ’টা একুশে। হাসিনা দিন বলতে বুঝেছিলেন শনিবার রাত বারোটা পর্যন্ত। তিনি তার নিজের সুবিধার্থে ক্যালেন্ডার তারিখ ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে দিন বলতে দিনের আলো থাকাকালীন দিনই বোঝায়।
হাসিনা : আপনি নিজেই বলছেন দুই দিনের মধ্যে আলোচনা ... হরতাল দেবেন না। ... শোনেন আমার কথা ... আমার এখানে ক্যামেরা নাই ...
খালেদা : আমার এখানেও ক্যামেরা-ট্যামেরা নাই। আমি নিজেই কথা বলছি। আমি বাসায় বসে কথা বলছি। অফিসে হলে আমার জন্য সুবিধা হতো। ক্যামেরা-ট্যামেরা থাকত। টেলিভিশনে দেখব আপনারাই ক্যামেরায় দেখাচ্ছেন। ... যে বলেছে ... টেলিভিশনে স্ক্রল দিয়েছে যে ওনার রেড টেলিফোন ঠিক আছে, তাকে স্যাক করেন। আমি এটা দেখতে চাই।
হাসিনা : এক্সচেঞ্জে আমি খবর নিলাম। ফোন ঠিক আছে। ১০-১২ বার ফোন করেছি।
খালেদা : ফোন ঠিক নাই। তাহলে বলতে চান, আমরা কেউ কানে শুনছি না। ফোন বাজে আর আমরা কেউ শুনি না !
হাসিনা : আমি কানে শুনব কি করে? গ্রেনেড হামলায় তো আমার এক কান এমনিতেই নষ্ট। ... ফোন আমি নিজে করেছি।
খালেদা : আপনি নিজে করলে কি হবে। আপনি একটা ডেড ফোনকে ... আপনি বলেছেন আপনি ফোন করেছেন।
হাসিনা : ফোন রিং হচ্ছিল।
খালেদা : রিং হবে কি করে। যে ফোন ডেড, সেটা রিং হবে কি করে। এটাই তো আপনার মন-মানসিকতার পরিচয়, আপনি সত্যি কথা বলছেন কি না।
হাসিনা : আমি সত্যি কথা বলছি। মিথ্যা বলার কিছু নেই ...
খালেদা : আমি কাল পর্যন্ত চেক করেছি। আপনি করতে পারেন। ... ফোন চেক করে রিপোর্ট করেছি। আপনারা ... লোকজন ... কেউ আসেন। তারা তো আমাদের মানুষ বলে মনে করে না। কাজেই আসেও না, ডেড ফোন ঠিক করার গরজও বোধ করে না। রেড টেলিফোন কেন? আজকাল তো মোবাইল ফোন আছে, টিঅ্যান্ডটি আছে ...
হাসিনা : রেড টেলিফোনের দোষ দিয়ে খামাখা মিথ্যা বলার তো দরকার নেই।
খালেদা : মিথ্যা বলব কিসের জন্য যে টেলিফোন ডেড? ডেডকে ডেড বলবই তো। আপনি বললে তো হবে না যে ফোন বিজি ছিল। এটা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।
হাসিনা : এক্সচেঞ্জে কালকে খবর নেওয়াই যাবে। এটা কোনো ব্যাপার না।
খালেদা : কিন্তু আপনার গুলশান এক্সচেঞ্জ থেকে যে বলেছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ সে সত্য কথাটা বলেনি।
হাসিনা : রেড টেলিফোন কিন্তু আলাদা এক্সচেঞ্জ। আরো ভালো করে জানবেন।
খালেদা : আলাদা এক্সচেঞ্জই। টেলিভিশনে স্ক্রল দিয়েছে। আপনি নিজে সামনে থাকলে দেখতেন।
হাসিনা : আমি গণভবনের অফিসে বসে আছি। আমার অফিসে কোনো টেলিভিশন নেই।
খালেদা : তাহলে কেন বলা হচ্ছে টেলিফোন ঠিক আছে?
হাসিনা : আপনার শিমূল বিশ্বাসের সাথে কথা হয়েছে. ..
খালেদা : আপনার সঙ্গে কথাই ছিল যে এই টেলিফোনে কথা হবে আমাদের। আমি তো বসে আছি এখানে। আধা ঘণ্টা বসে আছি যে আপনার টেলিফোন আসবে। আমরা তো গোপন কিছু বলব না। এক সময়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে একসঙ্গে কাজ করেছি। কেন কথা বলব না? এখনো বলতে চাই, কাজ করতে চাই। আসুন দেশের ...
হাসিনা : আগামী ২৮ তারিখ আসেন। আমরা আলোচনা করি।
খালেদা : না। আমি ২৮ তারিখ যেতে পারব না। আপনি যদি সত্যি আন্তরিক হন, ২৯ তারিখের পর ডেট দেন। আমি যাব।
শেখ হাসিনার চরিত্রের সঠিক পরিমাপ যে খালেদা করেছেন। সেটা এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খালেদা ঠিকই অনুমান করেছিলেন শেখ হাসিনার গণভবনে ক্যামেরা আছে।
সংলাপে এটা ছিল শেখ হাসিনার মিথ্যা কথনের দ্বিতীয় প্রমাণ। রেড ফোন বিষয়ে মিথ্যার পরে তিনি বিনা কারণে মিথ্যা বলেন, ‘আমার এখানে ক্যামেরা নাই।’
আইসিডিডিআরবি কলেরা প্রতিরোধক ওরস্যালাইন আবিষ্কার করেছে। অন্য কোনো চিকিৎসা সংস্থা কি মিথ্যা কথন রোগ মুক্তির ওষুধ আবিষ্কার করতে পারবে?
আরেকটা ছক্কা মারলেন খালেদা।
পঞ্চম ওভারে আলোচিত হয় সময়সীমা নিয়ে। হাসিনা মনে করিয়ে দেন খালেদা দুই দিন সময় দিয়েছিলেন আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার জন্য। খালেদার ব্যাটিং এই পর্যায়ে সময়সীমা বিষয়ে দুর্বল কিন্তু ধর্মীয় প্রসঙ্গে খালেদা শক্তভাবে ব্যাট করেন।
হাসিনা : আপনি কালকে বললেন ...
খালেদা : না, আমি কর্মসূচি দিয়ে ফেলেছি। এখন সম্ভব না।
হাসিনা : আপনি নিজেই বলেছেন, দুই দিনের মধ্যে আলোচনার জন্য না ডাকলে হরতাল দেবেন।
খালেদা : আমি হরতাল দিয়ে ফেলেছি। আগে বলা উচিত ছিল।
হাসিনা : আপনি আপনার বক্তব্যটা আবার শোনেন।
খালেদা : হ্যা, এখন আমি নিজে শুনলেও কর্মসূচি দিয়ে ফেলেছি। সঙ্গে সঙ্গেই বলেছি, কর্মসূচিও চলবে, আলোচনাও চলবে।
হাসিনা : আপনি যেহেতু বললেন দুই দিনের মধ্যে ...
খালেদা : আমি বলেছি। কর্মসূচি-সংলাপ একসঙ্গে চলবে।
হাসিনা : এর আগেই আমি ফোন করলাম।
খালেদা : না, হরতাল চলবে। কর্মসূচি ঠিক হয়ে গেছে। ১৮ দলের সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১৮ দল পাব কোথায় এখন? এখন কেউ নেই।
হাসিনা : ১৮ দল আপনি পাবেন, ডাকলেই পাবেন। আপনি ডাকলে হবে না, এটা কোনো কথা হলো নাকি। এটা কেউ বিশ্বাস করবে না।
খালেদা : বিশ্বাস করবে না ঠিক আছে। আগে ডাকলে হতো। কিন্তু এখন হবে না, এই কারণে ...
হাসিনা : আপনি বললেন, দুই দিনের মধ্যে আলোচনা না করলে আপনি হরতাল দেবেন। এ সময়ের মধ্যেই আপনাকে ফোন করলাম।
খালেদা : না, আপনি যদি কাল রাতেও ফোন করতেন, তাহলে কর্মসূচি বিবেচনা করা যেত। পুরো রাত চলে গেছে। সকালে অফিসে চলে গেছি।
হাসিনা : রাতে ফোন না দিলে তো আপনার হয় না। আমি রাত জাগি না।
খালেদা : আপনি কি সন্ধ্যার সময় ঘুমিয়ে পড়েন?
হাসিনা : আমি তো নামাজ পড়ি ... কোরআন তেলাওয়াত করি।
খালেদা : আমি জানি। আপনি খুব নামাজ পড়েন, কোরআন তেলাওয়াত করেন, আবার হুজুরও মারেন। সব কিছুই করেন।
হাসিনা : আপনারা কি করেন সেটাও সবাই জানে। কোরআন পোড়ান, মসজিদে আগুন দেন।
খালেদা : কোরআন শরিফ আপনারা পুড়িয়েছেন। কারণ এগুলো আপনারা বিশ্বাস করেন না। ২৯ অক্টোবরের পরে তারিখ দেন। এরপরে যদি চান আলোচনা হবে। এর আগে আলোচনার সুযোগ নেই।
হাসিনা : আপনি যে সময়সীমা বেধে দিয়েছিলেন আমি ঠিক সেই সময়ের মধ্যেই আপনাকে ফোন করেছি আলোচনার জন্য।
খালেদা : এখন আমার দলের কোনো নেতাকে পাব না। স্ট্যান্ডিং কমিটির নেতাদের পাব না। ১৮ দলের নেতাদের পাব না। কার সাথে কথা বলে আমি এটা প্রত্যাহার করব, আপনি বলেন? হাসিনা : আপনি কাউকে পাবেন না, এটা একটা কথা হলো? আপনি হুকুম দিলেই তো সব হবে।
খালেদা : আরে, আপনার ডিবি, এসবি তো আমার বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছে। আমার নেতারা কি করে আসবে বলেন?
হাসিনা : আপনারা ছুরি-কাচি-দা-কুড়াল নিয়ে মানুষকে আক্রমণ করার কথা বলছেন।
খালেদা : ছুরি-কাচি-দা-কুড়াল নিয়ে তো আপনারা করেন। বিশ্বজিৎকে আপনার লোকজন দা দিয়ে হত্যা করল না? আমরা ২৯ তারিখের আগে যেতে পারব না।
হাসিনা : আমার লোকজন না। যারা করেছে তারা অনেক আগে থেকেই বহিষ্কৃত। আমরা তাদের সবাইকে গ্রেফতার করেছি। তাদের বিচারও হচ্ছে।
খালেদা : যাদের দেখা গেছে তাদের গ্রেফতার করা হয়নি। সব নিরীহ মানুষকে ধরেন যদি তাহলে তো হবেই।
হাসিনা : তাদের গ্রেফতার করে দেখা গেছে তাদের মা-বাবা কেউ জামায়াত করে, কেউ বিএনপি করে।
খালেদা : না। তারা ছাত্রলীগ করে এবং ছাত্রলীগই করে। আমি আপনাকে আবারও রিকোয়েস্ট করছি, ২৯ তারিখের পরে যদি আলোচনা করতে চান, তাহলে যেকোনো দিন দেন। আমরা রাজি আছি। এখন এই কর্মসূচি থেকে বেরোনোর কোনো পথ নেই। আপনি ৩০ তারিখে ডাকেন, আমি যাব।
হাসিনা : আপনি জনগণের সামনে, জাতির সামনে যে বক্তব্যটা দিয়েছেন, সেটা অনুসরণ করেন। হরতাল প্রত্যাহার করেন।
খালেদা : সেটা করার পথ আর খোলা নেই এখন। টাইম ওভার হয়ে গেছে। আপনি যদি কাল রাতেও ফোন করতেন, আমি রাতেই মিটিং ডাকতাম।
পাঠকরা লক্ষ্য করবেন, হাসিনা অপ্রাসঙ্গিকভাবে দেশবাসীকে জানাতে চেয়েছেন তিনি মুসলমান, নামাজ পড়েন, কোরআন তেলাওয়াত করেন।
তার মনেই কি সন্দেহ আছে যে তিনি মুসলমান নন?
বারবার কেন তিনি প্রমাণ করতে চান ধর্মীয়ভাবে তিনি একজন মুসলমান?
পরিহাস এই যে, শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ, যেটি অতীতে ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ, এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মুসলিম বিদ্বেষী দল রূপে পরিচিত। হাসিনা সরকার ৬ মে ভোর রাতে নিরস্ত্র, নিষ্পাপ ও ধর্মপরায়ণ মুসলিমদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। শেখ হাসিনা তাদের নিয়ে বিদ্রুপ করেছেন। বলা হয়েছে শাপলা চত্বরে কেউ হতাহত হয়নি। সেখানে শরীরে রং মেখে মানুষ পড়ে ছিল। পাখি হয়ে ফুরুৎ করে আকাশে উড়ে গিয়েছে।
পাঠকদের জানা উচিত যে, হাসিনা-খালেদার সংলাপের এই অংশের কিছুটা, প্রথম আলো ও অন্যান্য পত্রিকা চেপে গিয়েছে। হাসিনা যে মুসলিম ধর্ম নিয়ে দ্বৈত আচরণ করেন সেটা যেন ধরা না পড়ে সে বিষয়ে এসব পত্রিকা সতর্ক ছিল।
এখানে আরো লক্ষণীয় যে, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড সংশ্লিষ্টদের সম্পর্কে হাসিনা বলেন, তারা ছাত্রলীগের নয় এবং তাদের বাবা-মা ছিল জামায়াত-বিএনপি পন্থী।
খালেদা মনে করিয়ে দিতে পারতেন হাসিনাকে যে তার পিতা শেখ মুজিব প্রথমে ছিলেন পাকিস্তানি। হাসিনার উৎসাহে প্রকাশিত তার পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে প্রতিষ্ঠিত হয় যে শেখ মুজিব তার রাজনীতির অধিকাংশ জীবনে ছিলেন পাকিস্তানে বিশ্বাসী একজন নেতা। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়েছিল ১৯২০-এ এবং ১৯৭০ পর্যন্ত তিনি ছিলেন পাকিস্তানি নেতা। জীবনের শেষ সময়ে সাড়ে চার বছর তিনি ছিলেন বাংলাদেশি নেতা। তাহলে বংশানুক্রমিকভাবে হাসিনাও কি পাকিস্তানে বিশ্বাসী? যেমনটা তিনি বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের সম্পর্কে বলেছেন?
খালেদার দুই রান।
ষষ্ঠ ওভারে হাসিনা আরো দুটি মিথ্যা বলেন এবং ধরা পড়ে যান।
হাসিনা : আপনি দুই দিন সময় দিয়েছিলেন। আমি দুই দিনের মধ্যেই আপনাকে ফোন করেছি।
খালেদা : আপনি কি মনে করছেন এই হরতালেই আমাদের কর্মসূচি শেষ হয়ে যাবে!
হাসিনা : না, না। আপনি তো আরও হরতাল দেবেন। আপনি ৩৩০ দিন হরতাল দিয়েছিলেন। সেটা তো আমার মনে আছে।
খালেদা : ৩৩০ দিন দিইনি কিন্তু। আপনি ১৭৩ দিন হরতাল দিয়েছেন। মনে নেই? আচ্ছা আপনি বলেন, ১৯৯১ সালে আমরা দুজনে আন্দোলন করে গণতন্ত্র আনলাম। তারপরে সেখানে আপনি অপজিশনে গেলেন, তাতে কি আছে? আমরা একসঙ্গে কাজ করতাম। কিন্তু আপনি তো সংসদে ফোরে দাড়িয়ে বললেন এক দিনের জন্য আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না।
হাসিনা : এটা আমি বলিনি। নো।
হাসিনার দুটি মিথ্যা এবং খালেদার পর পর দুটি বাউন্ডারি। আট রান। হাসিনা ৩৩০ দিন হরতালের সংখ্যাটি ম্যানুফ্যাকচার করেন। কিন্তু এই ভেজাল পণ্য তাৎক্ষণিকভাবে খালেদা রিজেক্ট করে দিয়ে ১৭৩ দিন আওয়ামী হরতালের খাটি সত্যটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। সপ্তম ওভারে তিনি এটাও হাসিনাকে মনে করিয়ে দেন যে তার (খালেদার) প্রথম মেয়াদের সূচনায় হাসিনা কি বলেছিলেন।
খালেদা : এগুলোর তো রেকর্ড আছে। আর তত্ত্বাবধায়ক? তত্ত্বাবধায়ক তখন কার ছিল? জামায়াতের ছিল। আপনি তখন তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া মানবেনই না।
হাসিনা : তখন মাগুরার ইলেকশন ...
খালেদা : আরে, মাগুরার ইলেকশন? ভোলার ইলেকশন আপনি বলেন না কেন?
হাসিনা : ভোলার ইলেকশনের পরে যে সিচুয়েশন তৈরি হয় তখন উপায় ছিল কি? ওইভাবে ভোট কারচুপি করলে ...
খালেদা : এই সিচুয়েশন এখনো হয়েছে। আপনার পক্ষে আপনার ডিসি ভোট চেয়ে বেড়ায়। ডিসি নৌকায় ভোট চেয়ে বেড়ায়।
হাসিনা : ডিসি কি কথা বলছে আর পত্রিকা কি কথা বলছে ...
খালেদা : না। এগুলো ঠিক তো। আপনি কালকে ডিসিকে বলবেন ব্যালট বাক্স ভর্তি করো। নো। এগুলো হতে পারে না। আপনি যদি ৩০ তারিখে করতে চান আমি রাজি আছি। আমার এটা ফাইনাল। এর বাইরে আমি যেতে পারি না।
হাসিনা : না না। ডিসিরা ভোট চাইবে কি জন্য।
খালেদা : চেয়েছে তো। পত্রিকায় এসেছে তো।
হাসিনা : ভোট চাওয়ার লোকের আমার অভাব নাই। আমার দল তো এ দেশে সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই জন্ম নিয়েছে।
খালেদা : আমার দলও অনেক সংগ্রাম করে ক্ষমতায় এসেছে। এগুলো কথা বললে কথার পিঠে কথা আসবেই।
হাসিনা : আমি আবারও আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি হরতালটা প্রত্যাহার করেন।
খালেদা : আমি হরতাল প্রত্যাহার করতে পারব না। আপনি সময়মতো আমাকে টেলিফোন করেননি। সে জন্য আমি দুঃখিত। কালকে যদি টেলিফোন করতেন পরিবেশ পরিস্থিতি অন্যরকম হতো।
হাসিনা : আপনি কালকেই তো আলটিমেটাম দিলেন। কালকে একটার দিকেই তো আপনাকে ফোন করেছি। তা-ও পাইনি। আপনি বলছেন ফোন বাজছে না। কিন্তু আমার যে এডিসি দেড়টা পৌনে দুইটা থেকে চেষ্টা করেছে।
খালেদা : ফোন না বাজলে তো আমার কিছু করার নেই। আমি তো বলেছিলাম নয়টার সময় নেতাদের ডাকব, কথা বলব, তখনো তো আমাকে ফোন দিলেন না ...
হাসিনা : আমার জরুরি মিটিং ছিল। কোনো মিটিংয়ে আমি দেরি করতে পছন্দ করি না। অলরেডি দেরি হয়ে গিয়েছিল।
খালেদা : আপনি যদি মনে করেন ওই মিটিং বেশি ইমপরটেন্ট, না এটা বেশি ইমপরটেন্ট।
হাসিনা : না। সব মিটিংই তো ইমপরটেন্ট। আমার কথা বলার পর আপনি ১২টার দিকে নেতাদের সঙ্গে বসে হরতালটা প্রত্যাহার করে নিতেন।
খালেদা : মিটিং থেকে বের হয়েও আপনি কথা বলতে পারতেন। তাহলে আমার তখন সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো।
হাসিনাকে অষ্টম ওভারে খালেদা মনে করিয়ে দেন অতীতে জামায়াতের সঙ্গে মিলেমিশে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। তখন খালেদার সরকার নির্বাচিত সরকার হলেও হাসিনা সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন চাননি। এখন ডিসিদের মাধ্যমে হাসিনা যে কিভাবে ভোট ম্যানিপুলেট করবেন সেটাও স্পষ্ট বলে দেন খালেদা।
আলোচনার এই অংশে যখন আরেকটি ইমপরটেন্ট মিটিং ছিল বলে হাসিনা জানান, তখন খালেদা সংযত ছিলেন। দেশবাসী জানেন, যেকোনো মিটিংয়ের চেয়ে বেশি ইমপরট্যান্ট ছিল এই টেলি আলোচনা। কিন্তু হাসিনা এটাকেও খাটো করতে চেয়েছেন।
ব্যাড বোলিং।
এই সময়ে হাসিনা জানতেন না যে খালেদা তার এই দুর্বলতার সুযোগ একটু পরেই নেবেন।
হাসিনা : আপনি দয়া করে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেন।
খালেদা : এককভাবে আমি কিভাবে সিদ্ধান্ত নেব?
হাসিনা : আপনি বলেন যে, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি। সে অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আপনি হরতালটা প্রত্যাহার করছেন। সে কথা জনগণের সামনে বলেন।
খালেদা : না, সেটা তো হবে না। তাহলে আপনি বলবেন যে, আপনি নির্দলীয় সরকার মেনে নেবেন। তাহলে আমি হরতাল উইথড্র করব।
হাসিনা : তাহলে আর আলোচনার কি থাকল?
খালেদা : নো। আলোচনার অনেক থাকে। আলোচনার অনেক প্রক্রিয়া থাকে। আপনি বলেন যে, আমি নির্দলীয় সরকার মেনে নেব। তাহলে আমি হরতাল উইথড্র করব।
হাসিনা : আমার ৯০ ভাগ সিট থাকা সত্ত্বেও আমি আপনাকে আহ্বান জানাচ্ছি সর্বদলীয় সরকার করার জন্য।
খালেদা : সর্বদলীয় সরকার হয় না। আপনি এর আগেও বলেছেন। সেগুলো হতে পারে না। আপনি যদি বলেন যে, এখন আপনি নিরপেক্ষ সরকারের জন্য রাজি আছেন তাহলে আমি হরতাল উইথড্র করে নেব। আপনি বলেন।
হাসিনা : যারা মাইনাস টু করতে চেয়েছিল, তাদের আবার সুযোগ দিতে চান কেন?
খালেদা : আমি দিতে চাই না। সেটা আপনি দিতে চান। আপনি যে ভাষায় কথা বলেন।
হাসিনা : না আপনি তো খুব মধুর ভাষায় কথা বলছেন।
খালেদা : আপনি যে ভাষায় কথা বলেন সে জন্য আমরা আপনার বক্তব্য শুনিই না।
হাসিনা : আমরা যেটা চাচ্ছি যে, পার্লামেন্টে আমরা আছি। পার্লামেন্টে আমরা যেহেতু আছি, কখনো আপনি অপজিশনে কখনো আমি অপজিশনে। কখনো আমি সরকারে কখনো আপনি সরকারে। আমরা যা করব পার্লামেন্টের ভেতরেই করব।
খালেদা : না। না। আপনার মিটিংয়ের সময় তো আপনি নষ্ট করছেন। আপনার মিটিংয়ের টাইম তো আমি নষ্ট করতে চাই না। আপনার তো মিটিংয়ে যাওয়ার কথা। আপনি দেরি করছেন তো। আপনার মিটিংয়ের দেরি আমি করতে চাচ্ছি না। এভাবে সব কথা হয় না।
নবম ওভারে খালেদা কান্ত হয়ে পড়েন। তিনি সিদ্ধান্তে আসেন কোনো আলোচনার জন্য নয়, হরতাল বন্ধ করার জন্য ফোন করেছেন হাসিনা। তাই তিনি আলোচনা শেষ করার জন্য হাসিনাকে মনে করিয়ে দেন তার (হাসিনার) মিটিংয়ের কথা।
সুপার ব্যাটিং। ছক্কা।
আলোচনার এই অংশে কুমির বাহিনীর প্রতি হাসিনার বীতশ্রদ্ধা ফুটে ওঠে। তিনি মাইনাস টু-কারীদের বিরুদ্ধে বলেন। যদিও এই কুমির বাহিনীকে তিনি প্রচুর প্রলোভন-প্রমোশন-অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে আওয়ামী অনুগত করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন, বিশেষত গত এক বছরে।
হাসিনা : হরতালটা উইথড্র করে দেন।
খালেদা : না, আপনি বলেন আগে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। এটা নিয়ে আলোচনা হবে। তাহলে আমি হরতাল উইথড্র করে নেব।
হাসিনা : এটা নিয়ে তো যখন কথা হবে তখন আলোচনা হবে আপনাদের সঙ্গে।
খালেদা : আলোচনা তো কোন কোন ব্যক্তি নিরপেক্ষ হবে, নির্দলীয় কিভাবে হবে, আপনার ফর্মুলা থাকবে না আমার ফর্মুলা থাকবে, এগুলো নিয়ে তো আরো অনেক আলোচনা বাকি আছে।
হাসিনা : আপনি নিজের দলের লোকের ওপর ভরসা করেন না।
খালেদা : আমার দলের লোকের ওপর আমার ভরসা আছে। আপনি যদি বলেন যে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে রাজি আছেন, তাহলে কালকেই আমি হরতাল উইথড্র করে দেব। রাতের মধ্যে ঘোষণা দিয়ে দেব হরতাল উইথড্র হবে। আমরা কালকেই আপনার সঙ্গে আলোচনায় বসব। কোনো অসুবিধা নেই। আপনি শুধু এটুকু বলেন।
হাসিনা : আপনি সর্বদলীয়টা মেনে নেন।
খালেদা : না। সর্বদলীয় মানা যায় না। সর্বদলীয় মানা যায় না।
হাসিনা : পরে আবার কাকে আনবেন ফখরুদ্দীন, মইনউদ্দিন হয়ে যাবে। আপনি আর ফখরুদ্দীন, মইনউদ্দিন সৃষ্টি করবেন না। বরং যা করি আমরা নিজেরা নিজেরা করি।
খালেদা : আমি কিছুই করতে চাই না। আপনি নির্দলীয় সরকারে রাজি হলে বলেন, না হলে আপনি ৩০ তারিখের পরে ডেট দেন। আমি করব। হরতাল প্রত্যাহার হবে না। ২৯ তারিখের পরে ডেট দেন। আমি আলোচনা করব। হাসিনা : আমি ২৮ তারিখে আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি। আপনি আসেন।
খালেদা : আমি ২৮ তারিখে যেতে পারব না। হরতালের মধ্যে আমি কোথাও যাই না।
হাসিনা : কাদেরকে আনবেন বলেন। আপনি ২৮ তারিখে আসেন (পাশ থেকে কেউ শেখ হাসিনাকে কিছু বলে দিচ্ছিলেন)।
খালেদা : ২৮ তারিখে আমি যাব না। আপনাকে কে ওখান থেকে প্রম্পট করছে? হরতাল প্রত্যাহার হবে না। আপনি যদি ৩০ তারিখে রাজি থাকেন ...
হাসিনা : ধন্যবাদ। আপনি ভালো থাকেন।
দশম বা ফাইনাল ওভারে হাসিনা আবার ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের ভয় দেখান খালেদাকে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উচিত হাসিনার এই মানসিকতাকে জানা এবং বুঝা। খালেদা ওই ভয়ভীতিকে কোনো পাত্তা না দিয়ে, এক. নিজের দলের মানুষদের প্রতি অটল আস্থা প্রকাশ করেন, দুই. এককভাবে নয় তার দলের সবাইকে নিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করেন এবং তিন. টানা ৬০ ঘণ্টার হরতাল প্রত্যাহারে সংকল্পবদ্ধ থাকলেও ৩০ অক্টোবরে অথবা তার পরে অন্য কোনো দিনে আলোচনায় রাজি থাকার বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করেন।
ছক্কা।
হাসিনার বোলিং হয় ব্যর্থ। হাসিনার নাটক হয় ফপ।
এই টেলি সংলাপের নেট রেজাল্ট কি হবে তুমি মনে করো? বিএনপির মধ্যে? শামীম প্রশ্ন করল শরিফকে।
খালেদার প্রতি ১৮ দলীয় জোটের মধ্যে আস্থা আরো উজ্জীবিত হবে। তিনি যে আওয়ামী লীগের ফাদে পা দেননি, আন্দোলন থেকে সরে আসেননি Ñ বরং বলেছেন, আলোচনা এবং আন্দোলন একই সঙ্গে চলবে, এটা নেতা-কর্মীদের আশ্বস্ত করবে। জোটের মধ্যে বিএনপির সহযাত্রীরা লক্ষ্য করবেন খালেদা তাদের সবার মতামত নিয়ে আলোচনায় থাকতে চান। শেখ হাসিনার ভাষায় খালেদা হুকুম করবেন না। এর ফলে জোটের মধ্যে খালেদার গণতান্ত্রিক অবস্থান সংহত হয়েছে। শরিফ উত্তর দিল।
আর আওয়ামী লীগের মধ্যে?
আওয়ামী লীগ প্রথমে মনে করবে এই টেলি সংলাপের ফলে খালেদা উত্তেজিত, একরোখা এবং অসহিষ্ণু রূপে প্রমাণিত হবেন। অন্য দিকে তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ধৈর্যশীল সমঝোতাকামী এবং নমনীয় রূপে আবির্ভূত হবেন। তাই আওয়ামী লীগ চাইবে এই টেলি সংলাপের পূর্ণ বিবরণ মিডিয়াতে প্রকাশ করতে। তথ্য মন্ত্রী ইনু সেদিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু পরে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারবে। তারা বুঝতে পারবে প্রতিটি পয়েন্টে খালেদা তাৎক্ষণিক উত্তরে সত্য কথাগুলোই বলেছেন এবং হাসিনার যেসব সমালোচনা তার দলের মধ্যেও হয়, সে বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। তখন আওয়ামী লীগ চাইবে এই টেলি সংলাপ প্রকাশের দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে। সংলাপ প্রকাশ হয়ে গেলে তার দায়-দায়িত্ব বিএনপির ওপর চাপিয়ে দেয় তারা । আওয়ামী লীগ তখন আরেকটা ভুল করবে। শরিফ বলল।
সার্বিকভাবে কি প্রতিক্রিয়া হবে?
অধিকাংশ মানুষই হতাশ হবে। তারা বুঝবে টেলি সংলাপে সংকট সমাধানে আলোচনা বিষয়ে নয়Ñ হরতাল বানচালে হাসিনা এই টিভি শো করেছিলেন। তারা বুঝবে সংগত কারণে খালেদা উত্তেজিত এবং আক্রমণাত্মক ছিলেনÑ খালেদা আন্তরিকভাবেই সংকট সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনা চেয়েছিলেন এবং এখনো তাই চান। হাসিনা প্রস্তাব দিয়েছেন সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। খালেদা চেয়েছেন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। সুতরাং বলা যায়, দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা শেষ হয়ে গিয়েছে। দুই নেত্রী যা বলার বলে দিয়েছেন। এর পরও কেনো তৃতীয় পক্ষের আগ্রহ এবং মধ্যস্থতায় দুই নেত্রী যদি কোনো আলোচনা করেন সেটা হতে হবে চূড়ান্ত গোপনীয়তা রক্ষার শর্তে। যদিও কেউই হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। রাষ্ট্রীয় খরচে ফালতু নৈশভোজে নয়Ñ ওই আলোচনা দিনের বেলায় অফিসের সময়ে হওয়া উচিত হবে। উভয় পক্ষের সময় মেনে চলার দায়িত্বে থাকতে হবে মধ্যস্থতাকারীকে। এই ধরনের আনুষ্ঠানিক, অপ্রকাশ্য কিন্তু ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজ করতে হবে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। শরিফ বলল।
আমাদের এই রচনার মধ্যে রিলিফ হিসেবে কার্টুন যাবে। খালেদা ব্যাট করছেন, হাসিনা বল করছেন, মহসিন, এমন একটা কার্টুন তুমি একে ফেল। আমাকে দেখিও। শামীম বলল।
খালেদা জিয়ার রেড টেলিফোন বিষয়ে শেখ হাসিনার কৌতূহল বহু বছরের। অতীতে হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি তার রেড টেলিফোনে পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেয়েছি।’ তার এই মন্তব্যের কারণ বোধ হয় ছিল, তিনি মনে করেন কোনো নারীর জন্য বরাদ্দকৃত রেড টেলিফোনে কোনো পুরুষের কণ্ঠস্বর শোনাটা অবাঞ্ছিত।
টিভিতে দেখা গেছে গুলশানে খালেদার বাসভবনের দোতলায় ড্রয়িংরুমে তিনি যে সোফায় বসে ছিলেন তার ঠিক উল্টো দিকে ছিল রেড টেলিফোন। সেই টেলিফোনের পাশের সোফায় বসে ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল পুরুষ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মাঝখানের সোফায় বসে ছিলেন খালেদার প্রেস সচিব পুরুষ মারুফ কামাল খান। এ ছাড়াও ওই ড্রয়িংরুমে উপস্থিত ছিলেন খালেদার বিশেষ সহকারী পুরুষ শামসুর রহমান শিমূল বিশ্বাস ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান পুরুষ শমসের মবিন চৌধুরী। সংলাপের সময়ে নীরব ছিলেন এই চার পুরুষ। রেড টেলিফোন বিকল ছিল। শেষ অবধি শিমূল বিশ্বাসের মোবাইল ফোনে হাসিনার এডিসির মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কল দেন সন্ধ্যা ছ’টা একুশে। সাইত্রিশ মিনিট কথা শেষের পর হাসিনা দাবি করেননি যে তিনি পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেয়েছেন। সংলাপকালীন খালেদার ড্রয়িংরুমের ছবি অল্প সময় দেখানো হয়। সেই ছবিতে দেখানো হয় একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের কর্মী রেড টেলিফোন পরীক্ষা করছেন। যাই হোক। মোট কথা হলো, এই আলোচনার বিশাল গুরুত্ব বুঝে খালেদা মাত্র চারজনকে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হতে বলেছিলেন। খালেদা এই আলোচনাকে কোনো নির্বাচনী ফটো অপরচুনিটি রূপে মনে করে
টিভি ক্যামেরা বাহিনীকে সেখানে উপস্থিত হতে বলেননি।
অন্যদিকে গণভবনে শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য পুরুষ আমির হোসেন আমু ও পুরুষ তোফায়েল আহমদ, উপদেষ্টা পুরুষ এইচ টি ইমাম, উপদেষ্টা পুরুষ ড. মসিউর রহমান, প্রেসিডিয়াম সদস্য পুরুষ কাজী জাফর উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক পুরুষ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা পুরুষ ইকবাল সোবহান চৌধুরী, উপদেষ্টা পুরুষ ড. মোদাচ্ছের আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক পুরুষ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক পুরুষ বদিউজ্জামান ভূইয়া প্রমুখ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী নারী ডা. দীপু মনি। অর্থাৎ দশ পুরুষ ও এক নারী। সেখানে টিভি ক্যামেরা ছিল। স্টিল ক্যামেরা অনবরত ফ্যাশ করছিল। প্রশ্ন হচ্ছে এতজনের উপস্থিতি কি আদৌ দরকার ছিল? খালেদার মতো দলের সাধারণ সম্পাদক, সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং তথ্য উপদেষ্টাসহ কোনো এক সহকারীর উপস্থিতিই কি যথেষ্ট ছিল না? এটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে দলবল নিয়ে ফটো অপরচুনিটির আয়োজন কেন হাসিনা করেছিলেন? হাসিনা-খালেদার আলোচনা তো ভাবগম্ভীর পরিবেশে হওয়া উচিত ছিল। খালেদা বুঝেছিলেন এই আলোচনার আনুষ্ঠানিকতা, ফর্মালিটি, প্রটোকল। হাসিনা এটা বুঝতে চাননি। চিফ রিপোর্টার ফয়েজ বলল।
তুমি হেডকাউন্ট করছ কেন? জেনডার কাউন্ট করছ কেন? শামীম জিজ্ঞাসা করল।
হেডকাউন্ট করছি এটা বোঝাতে যে খালেদার তুলনায় হাসিনা ডাবলেরও বেশি মানুষ তার পাশে রেখে একটা টিভি শো-র ব্যবস্থা করেছিলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ যখন ইরাক যুদ্ধ সংকট নিয়ে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে ফোন করেছিলেন, তখন তাদের দুজনার পাশে এত মানুষ ছিল না এবং সেই সংলাপের কোনো ছবি প্রকাশিত হয়নি। আমি মনে করি দেশের এত বড় সংকটে একটা মিনি হাট বসিয়ে ফটো অপরচুনিটির আয়োজন করে শেখ হাসিনা আলোচনার আনুষ্ঠানিক আবহ তৈরি করেননি। সম্ভবত সেই ইচ্ছাটি তার ছিলও না। সহজ ভাষায় বলা চলে তিনি লোক দেখানো সংলাপের আয়োজন করেছিলেন শুধু হরতাল বানচাল করার লক্ষ্যে। আমু এবং তোফায়েল গত পাচ বছর যাবৎ হাসিনার আশীর্বাদ বঞ্চিত হলেও এই আলাপের সময় কেন সেখানে থাকার আমন্ত্রণ পেলেন সেটাও বোঝা যায়নি। আর জেনডার কাউন্ট করলাম এটা বোঝাতে যে রেড টেলিফোনের পাশে সংগত কারণেই পুরুষের উপস্থিতি ঘটতে পারে। শেখ হাসিনার ওই রুমে নিশ্চয়ই একটা রেড টেলিফোন ছিল, যেখান থেকে তিনি খালেদাকে ফোন করতে চেয়েছিলেন। সেই রুমে এত প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় পুরুষের উপস্থিতি যে ছিল সেটা রেকর্ড করে রাখা উচিত। ফয়েজ আরো বলল।
আশ্চর্যের কথা এই যে, ১৩৭ বছর আগে ১০ মার্চ ১৮৭৬ আমেরিকায় বস্টন নিবাসী অ্যালেকজান্ডার গ্রেহাম বেল একটি অনির্ধারিত সংলাপ দিয়ে বিশ্বের সর্বপ্রথম ফোনালাপটি করেছিলেন এবং টেলিফোন আবিষ্কার যে করেছেন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। সেদিন ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে গিয়ে গ্রেহাম বেল-এর শরীরে ব্যাটারি এসিড ছিটকে পড়ে। তিনি টেলিফোনে বলেন, ‘মি. ওয়াটসন, কাম হিয়ার, আই ওয়ান্ট ইউ।’ তার অ্যাসিসট্যান্ট ওয়াটসন ছিলেন পাশের রুমে। তিনি দ্রুত দৌড়ে আসেন। এই দুর্ঘটনা সামলাতে গিয়ে তারা দুজন বুঝতে পারেন, যে যন্ত্রটি আবিষ্কারের জন্য দীর্ঘকাল যাবৎ কাজ করছিলেন, অবশেষে সেটি আবিষ্কৃৃত হয়েছে। বৈদ্যুতিক প্রবাহ বা ইলেক্টৃক কারেন্টের মাধ্যমে মানুষের কণ্ঠস্বর এক প্রান্তে পাঠানো সম্ভব এই যন্ত্রে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত বহু মিলিয়ন মানুষ বহু বিলিয়ন টেলিফোনে বহু টৃলিয়ন শব্দ বলেছেন।
টেলিফোন শব্দটি এসেছে দুটি গৃক শব্দ, টেলি এবং ফোন থেকে। টেলি শব্দের অর্থ দূর। ফোন শব্দের অর্থ কণ্ঠস্বর। টেলিফোনের মানে দাড়ায় দূরের কণ্ঠস্বর।
টেলিফোন জয় করেছে দূরত্ব। দূরের মানুষকে এখন নিমেষেই কাছে পাওয়া সম্ভব তার কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে। অথচ মোহাম্মদপুরে অবস্থিত প্রধানমন্ত্রীর গণভবন থেকে মাত্র তিন-চার মাইল দূরে অবস্থিত বিরোধী নেত্রীর বাসভবনে এই একবিংশ শতাব্দিতে নির্ধারিত সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোন করতে পারলেন না! আর কোনো কারণে না হোক, শুধু এই লজ্জাজনক প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর পদ এখনই শেখ হাসিনার ছেড়ে দেওয়া উচিত। মেরি বলল।
আজকাল মোবাইল ফোন কম্পানিগুলো যে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে সেটা দেখলে হাসিনা হয়তো কিছু উন্নতি লাভ করতেন। শামীম বলল।
তার মানে? উপস্থিত সবাই সমস্বরে জানতে চাইল।
গ্রামীণফোন বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ‘চলো বহু দূর’। ওই বিজ্ঞাপনে দেখা যায় আকাশ ছোয়া এক ভবন থেকে অনন্ত জলিল অনন্ত আকাশে লাফ দিচ্ছেন। অভিনেতা অনন্ত জলিল বলেন, ‘অসম্ভবকে সম্ভব করাই অনন্তর কাজ।’ শেখ হাসিনা তার পুত্র জয় দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে কোনো আমেরিকান কনসালটেন্টের উপদেশ নয়Ñ বাংলাদেশী অনন্ত জলিলের উপদেশ নিয়ে হয়তো অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারতেন। শামীম বলল।
না। এই সংলাপে বোঝা গেছে হাসিনা চতুর। তিনি দেশ জুড়ে বিলবোর্ড লাগালেও নিজে বিজ্ঞাপনে ভুলবেন না। অনন্তর মতো অনন্ত আকাশে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করবেন না। আর প্রিসাইসলি সেই কারনেই তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে রাজি হবেন না। মেরি বলল।
কিন্তু খালেদা জিয়া অনুসরণ করেছেন অন্য তিনটি টিভি কম্পানির স্লোগান, এয়ারটেল-এর ‘এক টাকার কথায়, এক টাকা ফেরত’-এর মতো তিনি হাসিনার কথার পিষ্ঠে তাৎক্ষণিক কথা বলেছেন। তার আই কিউ যে বেশি সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন। বাংলালিংকের বিজ্ঞাপনী স্লোগান এখন ‘নতুন কিছু করো।’ খালেদা জিয়া তার সংলাপে নতুন দিনের দিকে এগোনোর ডাক দিয়েছেন। তিনি তার আধুনিকতা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
সবশেষে তিনি রবি’র বিজ্ঞাপনী স্লোগান ‘জ্বলে উঠুন আপন শক্তিতে’ অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তার কোনো পুরুষ বা নারীর প্রম্পটিং দরকার হয়নি। তিনি আপন শক্তিতে একাই ব্যাট করে গিয়েছেন। ইনডিয়াতে ব্যাটসম্যান শচীন টেনডুলকার রিটায়ার করছেন। কিন্তু বাংলাদেশে খালেদা জিয়া জ্বলে উঠেছেন। শামীম বলল।
আমি রিপোর্ট পেয়েছি খালেদা যে নৈশভোজে যাননি তাতে আওয়ামী লীগের অনেকে হাফ ছেড়ে বেচেছেন। তারা জানেন রান্না পারদর্শী টমি মিয়া’র সার্টিফিকেট এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা সংগ্রহ করতে পারেননি। হাসিনা ভালো রাধুনি কি না তা নিয়ে সবার সংশয় আছে। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া নৈশ ভোজে এসে খারাপ রান্না খেলে তিন দিনের হরতালের বদলে ছয় দিনের হরতাল হয়তো ডেকে দিতেন। মেরি হাসল।
শেখ হাসিনার ওপর তাহলে কি কারোই আস্থা নেই? শরিফ বলল।
আছে। পাশের দেশের। সম্ভবত সেই শক্তিতেই তিনি জ্বলছেন এবং দেশবাসীকে জ্বালাচ্ছেন। শামীম বলল।
৩১ অক্টোবর ২০১৩
fb.com/ShafikRehmanPresents
দেশবাসীর তীব্র কৌতূহল মেটাতে সোমবার ২৮ অক্টোবর হরতালের দ্বিতীয় দিনে প্রথম আলো-র ফ্রন্ট পেইজে ‘তিক্ত কথাও হয়েছে দুই নেত্রীর’ শিরোনামে সেকেন্ড লিড করে। কিন্তু এটা টেলি সংলাপের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট ছিল না। এই দিনই তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, টেলি সংলাপটি প্রকাশিত হওয়া উচিত। ধারণা করা হয়, প্রথম আলো আইন বহির্ভূতভাবে সংলাপের খণ্ডিত অংশটি হয়তো তথ্যমন্ত্রীর পূর্ব অনুমতি নিয়েই করেছে।
প্রথম আলোর এই আইন বহির্ভূত, কিন্তু অগ্রণী, ভূমিকায় সাহসী হয় মানবজমিন। মঙ্গলবার ২৯ অক্টোবর হরতালের তৃতীয় দিনে মানবজমিন পুরো এক পৃষ্ঠা জুড়ে টেলিসংলাপের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো প্রকাশ করে। তবে এটিও পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট ছিল না। মানবজমিনের এই রিপোর্টে দেশ তোলপাড় হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে সোমবার দিবাগত রাতে অর্থাৎ মঙ্গলবার ২৯ অক্টোবর রাত দুইটা থেকে সরকার সমর্থক একাত্তর টেলিভিশন থেকে ওই টেলি সংলাপের পুরোটাই সম্প্রচার শুরু হয়ে যায়।
এরপর যা হবার তাই হয়।
মঙ্গলবার ২৯ অক্টোবর প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলে পূর্ণাঙ্গ অথবা খণ্ডিতভাবে টেলি সংলাপ সম্প্রচারিত হতে থাকে। এই দিন দেশ জুড়ে আলোচিত হতে থাকে আওয়ামী লীগ সরকার কেন এই সংলাপ প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিল? এই সংলাপ প্রকাশের ফলে কোন দলের লাভ হলো? আওয়ামী লীগের নাকি বিএনপির? কোন নেত্রীর ক্ষতি হলো? শেখ হাসিনার নাকি খালেদা জিয়ার? কোন দলের নেতাদের কি প্রতিক্রিয়া হলো? সাধারণ মানুষ সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে কিভাবে নিল?
এ সবের মধ্যেই কেটে গেল ২৯ অক্টোবর ২০১৩ হরতালের তৃতীয় দিন। টানা ৬০ ঘণ্টার এই হরতালে নিহত হন ১৩ জন। আহত হন হাজারের বেশি এবং এদের মধ্যে ছিলেন পুলিশ, সাংবাদিক ও টিভি ক্যামেরাম্যান।
এই তিন দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমনটা ভয় করে হরতাল তুলে নেয়ার জন্য বারবার খালেদাকে অনুরোধ করেছিলেন, ঠিক তেমনটাই ঘটে যায় দেশ জুড়ে।
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় সর্বাত্মকভাবে হরতাল পালিত হয়। তবে রাজধানী ঢাকার চেয়ে মফস্বল শহরগুলোতে হরতালের তীব্রতা ছিল অনেক বেশি। ঢাকার হরতালও গত পাচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠোর ছিল। রাজধানীতে প্রাইভেট কার চলাচল ছিল না। বাস চলাচল ছিল খুব কম। অধিকাংশ দোকানপাট ছিল বন্ধ। স্কুল-কলেজ ছিল বন্ধ। ঢাকা ছিল ফাকা। সারা দেশ জুড়ে গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। বাস ডিপোতে আগুন ধরানো হয়েছে। বাস পুড়েছে। মোটরসাইকেল পুড়েছে। পথে পথে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। রেল লাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। মফস্বলে গাছের গুড়ি কেটে পথে ফেলা হয়েছে। আন্তজেলা চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
উত্তর বাংলাদেশে বিএনপি নেতা আসাদুল হাবিব দুলু প্রভাবিত লালমনিরহাটে প্রায় দশ হাজার মানুষ তীর-ধনুক, বল্লম, দা-কুড়াল হাতে জমায়েত হয়। শিফট ডিউটি করে তারা চব্বিশ ঘণ্টা জেগে থাকে। ভয়ে পুলিশ তাদের বাধা দেয়নি।
কাছাকাছি এলাকায় বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট আবু বকর সিদ্দিক প্রভাবিত কুড়িগ্রামের রৌমারি উপজেলার দাতভাঙ্গা ইউনিয়নে পুলিশ-বিজিবিকে ঘেরাও করে রাখে কয়েক হাজার গ্রামবাসী। তবে তিন দিন ঘেরাওয়ের মধ্যে তাদের নিয়মিত খাবার ও পানি দেয় গ্রামবাসী। এখানে বিজিবি-র তিনটি প্লাটুন এসে পৌছালেও তারা গুলি চালাতে সাহস পায়নি। তারা কুড়িগ্রামের জননেতাদের সঙ্গে আলোচনা চালান। সমঝোতা হয় যে, ওই এলাকার কারো বিরুদ্ধে মামলা হবে না। তখন ঘেরাও তুলে নেয়া হয়।
মফস্বলে এ ধরনের বহু ঘটনার ফলে সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মচারিদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অভাব সৃষ্টি হয়। এক দিকে কিছু পুলিশ যেমন অতি সক্রিয় থেকেছে, অন্য দিকে কিছু পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকতে চেয়েছে। কেউ বা পালিয়ে গিয়েছে। কেউ বা ছুটি নিতে চেয়েছে। শেখ হাসিনার কথিত কুমির বাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন অস্থিরতার গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।
টানা হরতালের ফলে বিভিন্ন নিরাপত্তাবাহিনীর মধ্যে গভীর ভীতি, চরম দুর্বলতা ও তীব্র অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লে তাদের চেইন অফ কমান্ড ভেঙে যেতে পারে এবং তার ফলে তাদের ওপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার ভাঙন শুরু হবে এই আশঙ্কাতে শেখ হাসিনা অনুরোধ করেছিলেন হরতাল তুলে নিতে।
শেখ হাসিনার আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে। আন্দোলন দমন সম্ভব হয়নি। ট্যাকটিকালি এটা সম্ভবও ছিল না। কারণ একদিকে প্রধানমন্ত্রী যখন আলোচনা ও শান্তির কথা বলছেন তখন তার পক্ষে সংঘর্ষ ও অশান্তির দিকে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিরোধী জোটের চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে হতাহতের সংখ্যা হয়েছে কম। ভবিষ্যতে আন্দোলনে হতাহতের সংখ্যা হবে বেশি। কারণ, তখন সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করবে।
বুধবার ৩০ অক্টোবরে প্রায় সব দৈনিক পত্রিকা দুই নেত্রীর টেলি সংলাপ প্রকাশ করে। তবে সাধারণ পাঠক এখানে হোচট খেয়েছেন। কারণ, কোনো পত্রিকাই সংলাপের সঠিক পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেনি। তারা নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে সংলাপের অসম্পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেছে। যদিও তাদের কেউ কেউ, যেমন প্রথম আলো দাবি করেছে হুবহু বিবরণ প্রকাশ করা হলো।
বুধবার ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যায় সম্পাদক শামীম তার রুমে সহকর্মীদের ডেকে বৃফিং দিচ্ছিল। উপস্থিত ছিল নিউজ এডিটর মেরি, অ্যাসিসট্যান্ট এডিটর শরিফ চৌধুরী, চিফ রিপোর্টার ফয়েজ আনসারি এবং আর্টিস্ট মহসিন আহমেদ।
যারা টিভিতে অথবা ইন্টারনেটে এই টেলি সংলাপ শুনেছেন তারা জানবেন হাসিনা-খালেদা কি বলেছিলেন। কিন্তু পত্রিকা পড়ে সেটা তারা জানবেন না। পত্রিকাগুলোর এই ব্যর্থতার একটা কারণ হতে পারে ইচ্ছাকৃত। অন্যান্য কারণ হতে পারে রেকর্ডিংয়ে ওভারল্যাপিং কথাবার্তা অর্থাৎ একজন কথা বলার সময় অপরজনও কথা বলছিলেন। আর একটি কারণ হতে পারে রেকর্ডিংয়ে কিছু অংশে অস্পষ্টতা। তাই শুকতারায় পূর্ণ বিবরণটা প্রকাশ করা উচিত। মেরি বলল।
কিন্তু গতকাল বিভিন্ন পত্রিকাতে তো প্রায় পুরো সংলাপই প্রকাশিত হয়েছে। আমরাও তো দেখেছি। তাহলে আমরা নতুন কি দেব পাঠকদের? চিফ রিপোর্টার ফয়েজ জানতে চাইল।
আমরা টেলি সংলাপের বিভিন্ন অংশের বিশ্লেষণ দেব। মতামত দেব। হাসিনা-খালেদা আরো যা বলতে পারতেন সেটা অনুমান করব। এ সবই ছাপব। সংলাপটা কমপিউটারে অন করো। আমাদের বিশ্লেষণে যে রেটিং দেব সেটা কৃকেটের পরিভাষায় দেব। নিউ ইয়র্ক নিবাসী কলামিস্ট মোহাইমেন জায়গীরদারকে ফলো করব। তিনি অতীতে কৃকেটার ছিলেন। এখন টাইমস স্কোয়ারে বম্বে মসালা নামে একটি সফল রেস্টুরেন্ট চালান। তুমি নোট করতে থাকো। শামীম নির্দেশ দিল শরিফকে।
কমপিউটারে শুরু হলো সংলাপ।
শরিফ নোট, প্যাড ও বলপয়েন্ট নিয়ে রেডি হলো।
সøামালাইকুম
জি, এডিসি সাহেব।
হ্যা, শিমূলদা, আপনি তো ফোন দিলেন না।
না, না। আমরা তো অপেক্ষা করছি আপনার জন্য। ছয়টা থেকে ম্যাডাম বসে রয়েছেন।
না, না। আপনাদের তো কল করার কথা।
না। এ রকম কোনো কথা তো আপনার সঙ্গে আমার হয়নি। আপনি ছয়টায় ফোন দেবেন। ম্যাডামকে আমি আধা ঘণ্টা ধরে বসিয়ে রেখেছি।
আমি আপনাকে বলিনি যে আমি ফোন দেব। বিকজ আমরা এক্সপেক্ট করছি আপনারা ফোন দেবেন।
না, আপনি উল্টা কথা বলছেন। এ ধরনের কোনো কথা হয়নি। আমি ম্যাডামকে বলেছি ...
না, আমিও তো বলিনি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফোন দেবেন। আমি বলেছি ...
আপনি টেলিফোন করে মিলিয়ে দেবেন। এটা আপনার ডিউটি যে আপনি টেলিফোন করিয়ে মিলিয়ে দেবেন। ম্যাডাম এখন পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন।
আমরা অপেক্ষা করছি আপনার কলের জন্য।
ম্যাডাম এখনো বসে আছেন। আপনি দেন, এখনই দেন। ম্যাডামকে দিচ্ছি আমি।
আছেন ওখানে আপনারা?
জি, জি। ম্যাডাম এখনো আছেন।
আচ্ছা ওয়েট করেন।
ম্যাচ ওপেনিংয়ের আগে পিচ পরীক্ষাতেই দুই দলের মধ্যে মতানৈক্য দেখা গেল। এখানে শিমূল বিশ্বাস জিতলেন। কারণ দেশবাসী জানত ফোন কল আসবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। রোববার ২০ অক্টোবরে দুপুরে ক্যাবিনেট মিটিংয়ের পর শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল সেদিনই তিনি খালেদা জিয়াকে ফোনের চেষ্টা করেছিলেন। এরপরে শুক্রবার ২৫ অক্টোবর বিকেলের জনসভায় খালেদা জিয়া সরকারকে প্রস্তাব দিতে বলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চিঠিও দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর এডিসি যখন শনিবার ২৬ অক্টোবরে ফোন করেন তখন বল সরকারের হাতে ছিল।
খালেদা জিয়া : হ্যালো, হ্যালো।
শেখ হাসিনা : হ্যালো, সøামালাইকুম, কেমন আছেন?
খালেদা জিয়া : আমি আছি, ভালো আছি।
শেখ হাসিনা : আমি ফোন করেছিলাম আপনাকে দুপুর বেলা, পাইনি।
খালেদা : দেখেন, এই কথাটা যে বলছেন, তা সঠিক নয়।
হাসিনা : আমি আপনাকে জানিয়ে দিতে চাই ...
খালেদা : আপনাকে প্রথমে আমার কথা শুনতে হবে। আপনি যে বলছেন দুপুরে ফোন করেছিলেন, দুপুরে কোনো ফোন আসেনি। এই কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। দুপুরে কোনো ফোন আসেনি আমার এখানে।
হাসিনা : আমি রেড ফোনে ফোন দিয়েছিলাম।
খালেদা : রেড ফোন তো দীর্ঘদিন ধরে, বছর ধরে, ডেড পড়ে আছে। আপনারা গভর্নমেন্ট চালান, কি খবর রাখেন? গভর্নমেন্ট চালাচ্ছেন, এই খবর রাখেন না যে বিরোধীদলীয় নেতার ফোন ঠিক আছে কি না। আর আপনি যদি ফোন করবেনই, তাহলে গতকালই আপনার লোক এসে ফোন ঠিক করে দেওয়া উচিত ছিল। দেখে যাওয়া উচিত ছিল যে বিরোধীদলীয় নেতার ফোন ঠিক আছে কি না।
হাসিনা : রেড ফোন সব সময় ঠিক থাকে।
খালেদা : আপনারা লোক পাঠান। এখনই লোক পাঠান। দেখে যান ফোন ঠিক আছে কি না।
হাসিনা : আপনি তো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আপনি জানেন, রেড ফোন সব সময় ভালো থাকে।
খালেদা : ভালো থাকে তো, তবে আমারটা ভালো নেই। আমারটা তো ভালো নেই।
হাসিনা : ভালো আছে, আমি যখন ফোন করেছিলাম, সেটা ভালো ছিল।
খালেদা : না, সেদিনও চেক করেছি। আপনারা যদি সত্যি কথা না বলেন, তাহলে চলবে না।
হাসিনা : আমার সত্যি কথা না বলার তো কিছু নেই। আমি কয়েকবার ফোন দিয়েছি।
খালেদা : হঠাৎ করে কি মৃত ফোন জেগে উঠবে? আপনার টেলিফোন এত পাওয়ারফুল যে ডেড ফোন জেগে উঠবে!
হাসিনা : ঠিক আছে, যেকোনো কারণেই আপনি ফোনটা ধরতে পারেন নাই।
খালেদা : না, ধরতে পারি নাই না। আমি এখানে বসা। আমি এর মধ্যেই ঘুরি। ছোট্ট জায়গা, ছোট্ট জায়গার মধ্যেই আমি ঘুরি। এই ফোন বাজলে আমি না ধরার কোনো কারণ থাকতে পারে না। ডেড ফোন বাজতে পারে না। বুঝেছেন? এটাই হলো সত্যি কথা।
হাসিনা : দেখুন, ডেড ছিল, না ডেড করে রাখা হয়েছে ...
খালেদা : ডেড ছিল। বহু কমপ্লেইন আপনাদের কাছে গেছে। কিন্তু আপনারা তো ... রেড ফোনে আমার সাথে কথা বলার লোক নেই। কাজেই আমি কার সাথে কথা বলব?
হাসিনা : আমি আগামীকাল দেখব, কেন আপনার ফোন এ রকম ডেড ছিল।
খালেদা : সে তো দেখবেন, ভালো কথা।
কৃকেটপ্রেমীরা জানেন ফার্স্ট ওভারটি কত ইম্পরটেন্ট। ফার্স্ট ওভারেই যদি বোলার একটা উইকেট নিতে পারেন তাহলে তার দলের আধিপত্যের সূচনা হয়। অন্য দিকে ফার্স্ট ওভারে যদি ওপেনিং ব্যাটসম্যান রান করতে পারেন তাহলে তার দলের আধিপত্যের সূচনা হয়। বাউন্ডারি হাকালে তো কথাই নেই। ওভার বাউন্ডারি বা ছক্কা মারলে তো সুপার-ডুপার।
দেখা যাচ্ছে ফার্স্ট ওভারের ফার্স্ট বলেই হাসিনা নো-বোল করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি ফোন করেছিলাম আপনাকে দুপুর বেলা। পাইনি।’
এর উত্তরে খালেদা বলেননি যে হাসিনা মিথ্যা বলছেন। খালেদা বলেন ভদ্রভাবে, কথাটা সঠিক নয়। এখানে খালেদার সংযম প্রশংসনীয়। বিরক্তিকর এবং টেনশনপূর্ণ প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর খালেদা এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তত ছিলেন না। সংলাপের কমান্ড ও কনট্রোল তিনি তখনই নিয়ে নিতে মনস্থির করেন। তাই তিনি কমান্ডিং টোনে বলেন, ‘আপনাকে প্রথমে আমার কথা শুনতে হবে। আপনি যে বলছেন দুপুরে ফোন করেছিলেন, দুপুরে কোনো ফোন আসেনি। এই কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। দুপুরে কোনো ফোন আসেনি আমার এখানে।’
একটা ছক্কা মারলেন খালেদা।
এরপর যখন হাসিনা বলেন, ‘আমি রেড ফোনে ফোন দিয়েছিলাম’ তখন খালেদ টোটাল কমান্ড নিতে এগিয়ে যান।
খালেদা বলেন, ‘রেড ফোন তো দীর্ঘদিন ধরে, বছর ধরে, ডেড পড়ে আছে। আপনারা গভর্নমেন্ট চালান কি খবর রাখেন? গভর্নমেন্ট চালাচ্ছেন, এই খবর রাখেন না যে বিরোধীদলীয় নেতার ফোন ঠিক আছে কি না। আর ... গতকালই আপনার লোক এসে ফোন ঠিক করে দেয়া উচিত ছিল। দেখে যাওয়া উচিত ছিল যে, বিরোধীদলীয় নেতার ফোন ঠিক আছে কি না।’
খালেদা আরেকটি ছক্কা মারলেন।
খালেদা জিয়া তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তার প্রথম মেয়াদের শাসনকাল এখনো দেশের সবচেয়ে ভালো এবং গণতান্ত্রিক সময় রূপে পরিচিত হয়ে আছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা তুলেছেন। হাসিনা এর সদুত্তর দিতে পারেননি। খালেদা এখানে আরো বলতে পারতেন, এ জন্যই প্রধানমন্ত্রী হাসিনা জানেন না কুইক রেন্টাল সত্ত্বেও কতবার লোড শেডিং হচ্ছে, সরকারি ব্যাংকগুলো কিভাবে লুটপাট হচ্ছে, দেশে খুন-রাহাজানি-ছিনতাই কত বেশি হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম কিভাবে বাড়ছে।
এরপর খালেদা আদেশ দেন হাসিনাকে, ‘আপনার লোক পাঠান। এখনই লোক পাঠান। দেখে যান ফোন ঠিক আছে কি না।’
খালেদা দুই রান করলেন।
হাসিনাকে তিনি অর্ডার দিলেন, যে অর্ডারটি পরে হাসিনা পালন করতে বাধ্য হন।
হাসিনা তবু বলেন, ‘রেড ফোন সব সময় ভালো থাকে।’
প্রতি উত্তরে খালেদা বলেন, ‘আপনারা যদি সত্যি কথা না বলেন, তাহলে চলবে না।’
লক্ষণীয় যে, খালেদা কখনোই বলছেন না, হাসিনা মিথ্যা বলছেন। অর্থাৎ, প্রচণ্ড বিরক্তি সত্ত্বেও খালেদা তার ভাষায় সংযম রক্ষা করে চলছেন।
কিন্তু তারপরও যখন হাসিনা ডেড ফোন প্রসঙ্গটা লাইভ রাখেন, তখন খালেদা সারকাজম (Sarcasm)-এ বা শ্লেষাত্মক ভাষায় চলে যান। খালেদা বলেন, ‘হঠাৎ করে কি মৃত ফোন জেগে উঠবে? আপনার টেলিফোন এত পাওয়ারফুল যে ডেড টেলিফোন জেগে উঠবে? ... ডেড ফোন বাজতে পারে না। বুঝছেন? এটাই হলো সত্যি কথা।’ খালেদা এর পরেও কিছু শ্লেষাত্মক বাক্য প্রয়োগ করেছেন।
সুপার ব্যাটিং। আরেকটা ছক্কা।
এরপর হাসিনা একটা লুজ (Loose) বা ঢিলা বল করেন। তিনি বলেন, ‘দেখুন, ডেড ছিল, না ডেড করে রাখা হয়েছে ...’
খালেদা বলেন, ‘ডেড ছিল। বহু কমপ্লেইন আপনাদের কাছে গেছে ...’
হাসিনা বলেন, ‘আমি আগামীকাল দেখব, কেন আপনার ফোন এ রকম ডেড ছিল।’
ফার্স্ট ওভারে আলোচ্য বিষয় ছিল ডেড রেড টেলিফোন। ফোন করা বিষয়ে হাসিনার অসত্য বলার কারণ ছিল। তিনি চেয়েছিলেন শনিবার ২৬ অক্টোবরের শেষ মুহূর্তে ফোন করতে। ফোন রিসিভ করা বিষয়ে খালেদার অসত্য বলার কোনো কারণ ছিল না। তিনি যদি ফোন রিসিভ না করতে চাইতেন তাহলে শনিবার ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকতেন না এবং ছ’টা একুশের কলও রিসিভ করতেন না। তার জন্য এই কল ছিল খুবই ইমপরটেন্ট। কারণ, এরই ওপরে নির্ভর করছিল আগামী আন্দোলনের কর্মসূচি।
হাসিনা যে আন্তরিক ছিলেন না সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রোববার ২০ অক্টোবরে যেদিন পেশাজীবী সম্মেলনে চায়না-বাংলা মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে খালেদার যাওয়ার কথা ছিল সেদিন সকাল থেকে পুলিশ পাহারা দিচ্ছিল খালেদার বাসভবনের সামনে। ২৬ অক্টোবর শনিবার সকাল অথবা দুপুরে শেখ হাসিনার সদিচ্ছা থাকলে কোনো পুলিশ অফিসারকে খালেদার বাসভবনে পাঠিয়ে মেসেজ দিতে পারতেন। টি অ্যান্ড টিতে খোজ নিতে পারতেন। অথবা মোবাইল ফোনে খালেদার কোনো স্টাফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন। সেটা তিনি করেননি।
এখানে লক্ষণীয় খালেদা কখনো বলেননি, আপনিই (হাসিনা) আমার লাইন কেটে দেয়ার অর্ডার দিয়েছেন। যেমনটা আপনার ইঙ্গিতেই বিচার বিভাগের যোগসাজশে আমার বাড়ি থেকে আমাকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। যেমনটা এসএসএফ-এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। যেমনটা, সরকারি গাড়ি প্রত্যাহার করা হয়েছিল। যেমনটা, আমার বর্তমান গুলশানের ভাড়া বাড়ি থেকে উচ্ছেদের প্ল্যান করা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে রেড টেলিফোন ডেড করে দেয়াটা এমন আর কি?
আরো লক্ষণীয় যে, অচল টেলিফোন বিষয়ে সাধারণত মানুষ বলে থাকে, লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে, লাইন কাটা আছে, ইত্যাদি। কিন্তু খালেদা ‘লাইন কাটা’ বাক্যটি প্রয়োগ করেননি।
সেকেন্ড ওভারে আলোচ্য বিষয় ছিল রোববার ২৭ অক্টোবর থেকে ডাকা ৬০ ঘণ্টা হরতাল তুলে নেয়া।
হাসিনা : আমি আপনাকে ফোন করলাম। আগামী ২৮ তারিখে ... সন্ধ্যায় গণভবনে আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি। আপনি জানেন যে আমি ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি আগামী নির্বাচন সম্পর্কে। আমি আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি। ... গণভবনে আসার জন্য।
খালেদা : আপনার যদি সত্যিকারের আন্তরিকতা থাকে আলোচনা করার জন্য, আমার যেতে কোনো আপত্তি নেই। আমি একা যাব না। আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই আরো কেউ থাকবে।
হাসিনা : আপনি যতজন খুশি নিয়ে আসতে পারেন। সমস্যা নেই।
খালেদা : আমি দলবলসুদ্ধ নিয়ে যেতে চাই না। যাদের প্রয়োজন মনে করব, তাদের নিয়ে যাব। সেটা হতে হবে ২৮ তারিখের পরে। ২৯ তারিখ আমার হরতাল শেষ হওয়ার পরে।
হাসিনা : আমি অনুরোধ করব জাতির স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে হরতাল প্রত্যাহার করে নেন।
খালেদা : না। আমি ২৮ তারিখ যেতে পারব না।
হাসিনা : মানুষ খুন করা, আগুন মারা এসব বন্ধ করুন।
খালেদা : মানুষ খুন করা আপনাদের কাজ। আপনারা মানুষ জ্বালান, মানুষ মারেন, লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ মারেন। এসব রেকর্ডেড। আপনার নির্দেশে এবং আপনার মুখ দিয়েই এই শব্দ বেরিয়েছে। কাজেই এসব আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। আমি বলছি, হরতাল চলবে। ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় শেষ হবে। এরপর আলোচনা।
হাসিনা : আমি বলছি, দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে দয়া করে এই হরতাল প্রত্যাহার করুন।
খালেদা : না। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থেই আমি এই হরতাল দিয়েছি। যেহেতু আপনারা কোনো আলোচনায় আসতে রাজি নন। আপনার মন্ত্রীরা বলছেন, কোনো আলোচনা হবে না। আপনি নিজে বলেছেন। আমাদের প্রস্তাব রিজেক্ট করে দিয়েছেন। কোনো আলোচনার দরকার নেই, এটা আপনারা বলছেন। এখন আবার আলোচনার কথা বলছেন। সেই আলোচনা হতে পারে, আমাদের কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর।
হাসিনা : আমি আপনাকে অনুরোধ করছি ...
খালেদা : না। সেটা সম্ভব না। উদ্যোগটা যদি এক দিন আগে নিতেন, সেটা সম্ভব ছিল।
হাসিনা : এটা এক দিন আগের বিষয় না। আপনি জানেন, আমি বিভিন্ন দলের সঙ্গে বসছি ...
খালেদা : আমি জানি, আপনি ব্যস্ত মানুষ। আপনার মতো ব্যস্ত না হলেও আমাদেরও ব্যস্ততা আছে। ইচ্ছা করলে উপায় বের করা যায়। কিন্তু আপনারা সেটা করেননি। কালকে যে আমাদের সমাবেশের পারমিশন দিলেন, এত দেরিতে দিলেন কেন? কত দিন আগে পারমিশন চেয়েছি। মাইক পর্যন্ত লাগাতে দেন না। মানুষ এসে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথা শুনতে পারে না। এটা কোন দেশের গণতন্ত্রের নমুনা দেখছেন আপনি?
হাসিনা : আমি যে সবার সঙ্গে আলোচনা করব, তা কিন্তু বহুদিন আগেই সবাইকে ...
খালেদা : আমরা যে সমাবেশ করলাম, সেখানে মাইকের পারমিশন দেওয়া কেন হলো না?
হাসিনা : না, মাইক তো দেয়া হয়েছে। কয়েকটা মাইক ছিল।
খালেদা : না, আমরা যত দূর ইচ্ছা মাইক দেব। লোক বেশি শুনবে। লোক আসবে এ জন্য গাড়ি বন্ধ করে দেন, ১৪৪ ধারা জারি করেন। দেশে ইমার্জেন্সি চলছে নাকি? দেশে কি যুদ্ধাবস্থা চলছে যে এমন শুরু করে দিলেন আপনারা?
হাসিনা : আমি এ ব্যাপারে এখন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি না।
খালেদা : কথা বলতে না চাইলে তো কথাই নেই।
হাসিনা : কথাগুলো সত্য না। আপনারা তো মিটিং করছেন।
খালেদা : আপনারা মিটিং করতে দেবেন মাইক দেবেন না। এমন সময়ে পারমিশন দেবেন, যখন ডায়াসও বানাতে পারব না। আপনারা কি আগে মিটিং করেন নাই?
হাসিনা : সব মনে আছে। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা মনে আছে ...
খালেদা : গ্রেনেড হামলা আমরা করিনি, আপনারাই করেছেন।
হাসিনা : রাত ১১টায় পারমিশন দিয়েছেন, সেটাও মনে আছে। এসব কথা আপনাদের মুখে মানায় না।
খালেদা : মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ ছিল। সেখান থেকে যে ভেনু পরিবর্তন করে আপনাদের অফিসে নিয়ে গেছেন, সেটা পর্যন্ত আমাদের জানাননি। এসব পুরনো কথা বাদ দেন। এখন আপনাকে আমি বলছি, যদি সত্যিকারের আলোচনা করতে আন্তরিক হন, তাহলে আমাদের কর্মসূচির পরে ...
হাসিনা : আমরা নিশ্চয় ঝগড়া করতে চাই না।
খালেদা : আপনি তো ঝগড়া করছেনই।
হাসিনা : আপনি একতরফাই তো বলে যাচ্ছেন। আমাকে তো কথা বলারই সুযোগ দিচ্ছেন না।
খালেদা : আমি একতরফা বলব কেন। আপনি কথা বলছেন, আমি জবাব দিচ্ছি শুধু।
হাসিনা : আমি তো আপনার সঙ্গে কথা বলারই সুযোগ পাচ্ছি না।
খালেদা : আপনি বারবার বলছেন, হরতাল হরতাল। হরতাল এখন প্রত্যাহার হবে না। আমাদের কর্মসূচি শেষ হলে তারপর যদি ... আপনি জানেন। আপনি যদি ...
হাসিনা : হরতালের নামে মানুষ খুন করা অব্যাহত রাখবেন?
এখানে খালেদা ধরিয়ে দিয়েছেন ‘খুন’ শব্দটিতে হাসিনা অভ্যস্ত। এমনকি এই ফোন সংলাপে হাসিনাই প্রথম মানুষ খুন করা, আগুন মারা, প্রভৃতি বাক্য ব্যবহার করেছেন।
তৃতীয় ওভারে খুনের প্রতি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের আসক্তি আলোচিত হয়।
খালেদা : আমি মানুষ খুন করতে চাই না। আপনারা মানুষ খুন করছেন। কালকেও নয়জন মানুষ আমার খুন করেছেন আপনারা। ... আপনার ছাত্রলীগ, যুবলীগ করে না?
হাসিনা : না।
খালেদা : আপনার ছাত্রলীগ-যুবলীগের আমরা অস্ত্রসহ ছবি দেখাতে পারব। আপনার ছাত্রলীগ-যুবলীগ কিভাবে খুন করে নিরীহ মানুষকে।
হাসিনা : বললাম তো খুনের রাজনীতি আমরা করি না; বরং আমি দেখি ...
খালেদা : ... আপনাদের তো পুরনো অভ্যাস। আপনারা সেই স্বাধীনতার পর থেকে ’৭১-এ যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখনো এই হত্যা করেছেন। এত মানুষ হত্যা করেছেন। এগুলো ভুলে গেছেন আপনি?
হাসিনা : একাত্তরে আমরা মানুষ হত্যা করেছি?
খালেদা : হ্যা অবশ্যই, একাত্তরের পরে।
হাসিনা : যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য।
খালেদা : যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য নয়। আপনারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যদি ঠিকমতো করতেন তাহলে আমরা পূর্ণ সমর্থন দিতাম। কিন্তু আপনারা সেই ট্রাইব্যুনাল করেননি। না করে একতরফা করেছেন এবং আপনার দলে যে অনেক যুদ্ধাপরাধী আছে সেগুলো একটাও ধরেননি। সেগুলোকে একটাও কেন ধরেননি? আপনি তো প্রধানমন্ত্রী নন। দলের প্রধানমন্ত্রী। আপনি তো দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। নিরপেক্ষতার ঊর্ধ্বে আপনি যেতে পারেননি। নাহলে, আমার সঙ্গে এই আচরণ তো আপনারা করতেন না, যা করেছেন আপনারা। আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন, সেদিন আমার পার্টি অফিসে আপনারা যে আচরণ করলেন, এরপর আর বলতে হবে? বিরোধীদলীয় নেতাকে আপনারা সম্মান দিতে জানেন না। কিসের গণতন্ত্রের কথা বলেন আপনি?
এখানে স্বাধীনতার পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন আমলে মানুষ হত্যা বিষয়টি খালেদা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তবে শেখ মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধাবশত তিনি তার নাম উচ্চারণ করেননি Ñ যদিও হাসিনা সর্বদাই জিয়াউর রহমানের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন।
লক্ষণীয় যে, রক্ষী বাহিনীর নাম খালেদা করেননি। কথিত আছে, শেখ মুজিবের আমলে এই বাহিনীর হাতে অন্ততপক্ষে ত্রিশ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল।
আরো লক্ষণীয় যে, এখানে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষে অন্ততপক্ষে পনের লক্ষ মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি খালেদা বলেননি।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে যে দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে হাসিনা উঠতে পারেননি সেটাও দৃঢ়ভাবে বলে দিয়েছেন খালেদা। হাসিনার স্বৈরাচারী চরিত্রের উল্লেখ করেছেন সোমবার ২১ অক্টোবর নয়া পল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে ছাত্রদল নেতা টুকুর গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা নিয়ে। সেই রাতে এগারোটার সময়ে খালেদা গিয়েছিলেন অসুস্থ বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীকে দেখতে। ফেরার সময়ে খালেদার নিরাপত্তা স্টাফ, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মজিদকে হেনস্তা করে পুলিশ এবং টুকুকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। এ সবই ঘটে খালেদার চোখের সামনে। তবে তিনি সেখান থেকে সরে যাননি। বাকি সব নেতা-কর্মীকে নিরাপদে বাড়ি ফেরার সুযোগ করে দিয়ে সবশেষে তিনি নিজে গুলশানে ফিরে যান।
হাসিনার এই অগণতান্ত্রিক আচরণ তুলে ধরার জন্য দুই রান।
চতুর্থ ওভারটি ছিল অতীত নিয়ে।
খালেদা নিকট অতীতে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন, আমলে ফিরে যান। হাসিনা ফিরে যান আরো আগে।
হাসিনা : আপনার কথার জবাব দিতে গেলে আমাকে তো সেই ২০০১ থেকে অনেক কথা বলতে হবে।
খালেদা : সেটার জবাব আমিও দিতে পারি। আপনি দেবেন আমিও দিতে পারি ...
হাসিনা : ... এরশাদ বা তার দলের সাথে কি কি করেছিলেন। আর ২০০১ সালে ...
খালেদা : একাত্তর সালে আমরা কিছু করিনি। এরশাদের সময় যত করেছেন আপনারা। এরশাদ যখন একটি নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা নিল, তারপর আপনি বললেন, আই অ্যাম নট আনহ্যাপি। আপনি যখন বিবিসিকে বললেন, তারপরে আর কি থাকে? ... ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন কোন সংবিধানের অধীনে ক্ষমতা নিল ...
হাসিনা : ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন আপনার চয়েস ছিল।
খালেদা : ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন আমার চয়েস ছিল না। আপনার চয়েস ছিল। আপনি নিজে বলেছেন আমার আন্দোলনের ফসল। এগুলো ভুলে যান কেন? মানুষ তো ভুলে না সেগুলো।
হাসিনা : নয়জন অফিসার ডিঙিয়ে মইনউদ্দিনকে আপনি আর্মি চিফ বানিয়েছিলেন।
খালেদা : আপনি এমন অনেক অফিসারকে বাড়ি পাঠিয়েছেন। সেটা নয়জন না সাতজন, সেটা কথা নয়। আপনি অনেককে ডিঙিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছেন। মইনউদ্দিন যেই থাকুক না কেন, যখন এটা করল, সেখানে আপনারা ... সেই ইয়েতে (শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে) গেলেন কেন আপনি? সেটা সংবিধানসম্মত হয়নি। সংবিধানসম্মত ছিল না। সেটাতে কেন গেলেন আপনি? সেদিন তো আপনি মনে করেননি। আমরা দুই দলই তখন ক্ষমতার বাইরে ... তখন তো একবারও মনে করলেন না আমরা আলোচনা করি, ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। এরা সংবিধানসম্মত নয়। আপনি তো সেটা মনে করলেন না। চলে গেলেন সেখানে হাসিমুখে।
হাসিনা : ... আমি আগুনে বসেও পুষ্পের হাসি, হাসি। আমার বাবা, মা, ভাই ...
এখানে হাসিনা বিষয়টিকে হালকা করে ফেলেন। কিন্তু খালেদা তাকে মনে করিয়ে দেন এরশাদসহ সামরিক বাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে হাসিনার গভীর সম্পর্ক। খালেদা বলতে পারতেন, আপনার জন্য ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের সময়টা আগুন ছিল নাÑ সেটা আপনার জন্য ছিল ফুলের বাগান। তাই আপনি বলতে পারেন ফুলের হাসি হেসেছেন। প্যারোলে মুক্তি নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ে আপনার মুখে হাসিই ছিল। সেই সময়টা আগুন ছিল আমার জন্য এবং আমার দলের জন্য। আমি এক বছর জেলে থেকেছি।
হাসিনা ১৯৭৫Ñএ ফিরে যান। ছোট ভাই প্রসঙ্গের পরে তিনি তার বহুল ব্যবহৃত বাবা-মা’র প্রসঙ্গটি টেনে আনতে চান।
খালেদা : ... অতীত ছেড়ে দিয়ে আমি বলতে চাই এখন সামনের দিকে কি করে আগাবেন ... আপনার যদি সত্যি সৎ উদ্দেশ্য থাকে তাহলে আমরা সামনের দিকে কি করে এগোবো ... সামনের দিকে এগোতে চাই।
হাসিনা : আপনি তো অনেক অভিযোগ করলেন। আমি তো এত অভিযোগ করতে চাই না। ছোট্ট রাসেল ..., ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছেন।
খালেদা : দেখেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা আপনারা করিয়েছেন। আপনাকে হত্যা করতে কেউ চায়নি। ... আপনি যত থাকবেন, তত আমাদের জন্য ভালো। ... আপনি যত এ রকম অশ্লীল ভাষায় কথা বলবেন, তত আমাদের জন্য ভালো।
হাসিনা : ১৫ আগস্ট আপনি যখন কেক কাটেন...
খালেদা : ১৫ আগস্ট আমার জন্মদিন। আমি কেক কাটবই।
হাসিনা : খুনিদের উৎসাহিত করার জন্য যখন আপনি কেক কাটেন। ...
খালেদা : ... এটা বলবেন না। ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে কোনো মানুষের জন্ম হবে না? কোনো মানুষ পালন করবে না? এগুলো বাদ দেন। কথায় কথায় আপনারা বলেন। অনেক কথা বলেন জিয়াউর রহমানকে। আরে, জিয়াউর রহমান তো আপনাদের নতুন জীবন দান করেছেন। এগুলো কথা বলবেন না। বুঝেছেন! আপনারা তো বাকশাল ছিলেন। ... আপনারা জিয়াউর রহমানের বদৌলতে আওয়ামী লীগ হতে পেরেছেন। আদারওয়াইজ আওয়ামী লীগ হতে পারতেন না।
হাসিনা : ... রাসেলকে তো এই বাসায় ঘুরতেও দেখেছেন ...
এখানে শেখ হাসিনার ভাষা সম্পর্কে বহুল প্রচলিত কথাটি তাকে শুনিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়া। অন্যদিকে শেখ হাসিনা শুনিয়ে দিয়েছেন ১৫ আগস্টে খালেদার জন্মদিনে কেক কাটার বিষয়টি। খালেদা দৃঢ়ভাবে নিজেকে ডিফেন্ড করে ব্যাট করেছেন। নিজের জন্মদিনের প্রসঙ্গ ওঠার সুযোগে তিনি আজকের আওয়ামী লীগের জন্মদাতা হিসেবে জিয়াউর রহমানকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সিম্পলি বৃলিয়ান্ট। চার রান।
লক্ষণীয় যে, জিয়াউর রহমানের নাম ভাঙিয়ে খালেদা কোনো করুণা বা দয়াভিক্ষা করেননি। খালেদা মনে করিয়ে দেননি যে হাসিনার প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীত্বের সূচনাতেই জিয়ার মাজারে যাওয়ার বেইলি বৃজটি মিথ্যা অজুহাতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কবরে জিয়ার লাশ আছে কিনা সেই সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনা প্রায়ই তার প্রয়াত আত্মীয়-স্বজনের কথা বলে সহানুভূতি আদায় করতে চান।
তার এই শোক-ভিত্তিক রাজনীতি খালেদা কখনোই অনুসরণ করেননি। এমনকি এই ফোন সংলাপেও নয়।
অথচ হাসিনা নিহত ভাই রাসেল-এর উল্লেখ করেন। খালেদা আবারও তাকে সামনের দিকে এগোতে বলেন। চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় হাসিনার অতীতমুখিতা এবং খালেদার ভবিষ্যতমুখিতা।
খালেদা : নতুন করে শুরু করি। সেটাতে আপনি রাজি থাকেন, আসেন আমরা সুন্দর আলোচনা করি। আমার আলোচনা করতে আপত্তি নাই। কিন্তু সেই ডেট হতে হবে আমার হরতাল শেষ হওয়ার পর।
হাসিনা : আপনার হরতাল প্রত্যাহার করবেন না?
খালেদা : না, আমি হরতাল প্রত্যাহার করতে পারব না। এটা তো আমার ডিসিশন না। এটা ১৮ দলের ডিসিশন। আমি এটা কি করে একলা করব?
হাসিনা : আপনি ১৮ দলকে ডেকে নিয়ে বলেন ...
খালেদা : এখন সময় নাই। আপনি যে তাড়া করছেন। এখন তো খুজে পাওয়া যাবে না লোকজনকে। আপনি তো সবার পেছনে পুলিশ লাগিয়ে রেখেছেন। কি করে মানুষ পাওয়া যাবে, বলেন?
হাসিনা : আমরা পুলিশ লাগিয়ে রাখব কেন?
খালেদা : আপনি লাগিয়ে রাখবেন না তো কে রাখবে? পুলিশ ... কার কথায় ... আমার কথায় চলে? আপনি তো সবার বাসায় বাসায় রেইড করছেন। বস্তি থেকে পর্যন্ত আপনি লোক ধরে নিয়ে যাচ্ছেন।
হাসিনা : যেখানে বোমা ব্লাস্ট হয়ে যাবে ...
খালেদা : বোমা ব্লাস্ট হয়ে যাবে! বোমা ব্লাস্ট তো আপনারা করেন আর নাম দেন আমাদের। এগুলো তো আপনাদের পুরাতন ঐতিহ্য। আমি বলতে চাই, যদি আপনারা ২৯ তারিখের পরে করেন আমি রাজি আছি। আমি নিশ্চয় কথা বলতে রাজি আছি।
হাসিনা : আপনি আলটিমেটাম দিলেন দুই দিনের। আমি দুই দিনের মধ্যেই ফোন করলাম। অথচ এখন হরতালও করবেন আবার বলছেন ২৯ তারিখের পরে। আপনি কি বক্তৃতা দিলেন আর আজকে এখন কি বলছেন, আপনি একটু ভেবে দেখেন।
খালেদা : আমি বলেছি আলোচনা চলুক, কর্মসূচিও চলবে।
খালেদা যে দূরদর্শী সেটা প্রমাণিত হয় এখানে। শুক্রবার ২৫ অক্টোবরে জনসভায় তিনি যুগপৎ আলোচনা এবং কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। তাই হাসিনা একটা ফাস্ট বোল করলেও খালেদা সেটা রুখে দিতে পারেন। শেখ হাসিনা তার সংলাপে কয়েকবার বলেছেন তিনি খালেদা জিয়ার বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই ফোন করেছেন। তার এ কথা ঠিক নয়। কারণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খালেদা শুক্রবার বিকাল সোয়া পাচটায় তার ভাষণ শেষ করেন। শনিবার বিকাল পাচটায় খালেদার বেধে দেয়া সময়সীমা শেষ হয়ে যায়। হাসিনা ফোন করেন শনিবার সন্ধ্যা ছ’টা একুশে। হাসিনা দিন বলতে বুঝেছিলেন শনিবার রাত বারোটা পর্যন্ত। তিনি তার নিজের সুবিধার্থে ক্যালেন্ডার তারিখ ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে দিন বলতে দিনের আলো থাকাকালীন দিনই বোঝায়।
হাসিনা : আপনি নিজেই বলছেন দুই দিনের মধ্যে আলোচনা ... হরতাল দেবেন না। ... শোনেন আমার কথা ... আমার এখানে ক্যামেরা নাই ...
খালেদা : আমার এখানেও ক্যামেরা-ট্যামেরা নাই। আমি নিজেই কথা বলছি। আমি বাসায় বসে কথা বলছি। অফিসে হলে আমার জন্য সুবিধা হতো। ক্যামেরা-ট্যামেরা থাকত। টেলিভিশনে দেখব আপনারাই ক্যামেরায় দেখাচ্ছেন। ... যে বলেছে ... টেলিভিশনে স্ক্রল দিয়েছে যে ওনার রেড টেলিফোন ঠিক আছে, তাকে স্যাক করেন। আমি এটা দেখতে চাই।
হাসিনা : এক্সচেঞ্জে আমি খবর নিলাম। ফোন ঠিক আছে। ১০-১২ বার ফোন করেছি।
খালেদা : ফোন ঠিক নাই। তাহলে বলতে চান, আমরা কেউ কানে শুনছি না। ফোন বাজে আর আমরা কেউ শুনি না !
হাসিনা : আমি কানে শুনব কি করে? গ্রেনেড হামলায় তো আমার এক কান এমনিতেই নষ্ট। ... ফোন আমি নিজে করেছি।
খালেদা : আপনি নিজে করলে কি হবে। আপনি একটা ডেড ফোনকে ... আপনি বলেছেন আপনি ফোন করেছেন।
হাসিনা : ফোন রিং হচ্ছিল।
খালেদা : রিং হবে কি করে। যে ফোন ডেড, সেটা রিং হবে কি করে। এটাই তো আপনার মন-মানসিকতার পরিচয়, আপনি সত্যি কথা বলছেন কি না।
হাসিনা : আমি সত্যি কথা বলছি। মিথ্যা বলার কিছু নেই ...
খালেদা : আমি কাল পর্যন্ত চেক করেছি। আপনি করতে পারেন। ... ফোন চেক করে রিপোর্ট করেছি। আপনারা ... লোকজন ... কেউ আসেন। তারা তো আমাদের মানুষ বলে মনে করে না। কাজেই আসেও না, ডেড ফোন ঠিক করার গরজও বোধ করে না। রেড টেলিফোন কেন? আজকাল তো মোবাইল ফোন আছে, টিঅ্যান্ডটি আছে ...
হাসিনা : রেড টেলিফোনের দোষ দিয়ে খামাখা মিথ্যা বলার তো দরকার নেই।
খালেদা : মিথ্যা বলব কিসের জন্য যে টেলিফোন ডেড? ডেডকে ডেড বলবই তো। আপনি বললে তো হবে না যে ফোন বিজি ছিল। এটা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।
হাসিনা : এক্সচেঞ্জে কালকে খবর নেওয়াই যাবে। এটা কোনো ব্যাপার না।
খালেদা : কিন্তু আপনার গুলশান এক্সচেঞ্জ থেকে যে বলেছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ সে সত্য কথাটা বলেনি।
হাসিনা : রেড টেলিফোন কিন্তু আলাদা এক্সচেঞ্জ। আরো ভালো করে জানবেন।
খালেদা : আলাদা এক্সচেঞ্জই। টেলিভিশনে স্ক্রল দিয়েছে। আপনি নিজে সামনে থাকলে দেখতেন।
হাসিনা : আমি গণভবনের অফিসে বসে আছি। আমার অফিসে কোনো টেলিভিশন নেই।
খালেদা : তাহলে কেন বলা হচ্ছে টেলিফোন ঠিক আছে?
হাসিনা : আপনার শিমূল বিশ্বাসের সাথে কথা হয়েছে. ..
খালেদা : আপনার সঙ্গে কথাই ছিল যে এই টেলিফোনে কথা হবে আমাদের। আমি তো বসে আছি এখানে। আধা ঘণ্টা বসে আছি যে আপনার টেলিফোন আসবে। আমরা তো গোপন কিছু বলব না। এক সময়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে একসঙ্গে কাজ করেছি। কেন কথা বলব না? এখনো বলতে চাই, কাজ করতে চাই। আসুন দেশের ...
হাসিনা : আগামী ২৮ তারিখ আসেন। আমরা আলোচনা করি।
খালেদা : না। আমি ২৮ তারিখ যেতে পারব না। আপনি যদি সত্যি আন্তরিক হন, ২৯ তারিখের পর ডেট দেন। আমি যাব।
শেখ হাসিনার চরিত্রের সঠিক পরিমাপ যে খালেদা করেছেন। সেটা এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খালেদা ঠিকই অনুমান করেছিলেন শেখ হাসিনার গণভবনে ক্যামেরা আছে।
সংলাপে এটা ছিল শেখ হাসিনার মিথ্যা কথনের দ্বিতীয় প্রমাণ। রেড ফোন বিষয়ে মিথ্যার পরে তিনি বিনা কারণে মিথ্যা বলেন, ‘আমার এখানে ক্যামেরা নাই।’
আইসিডিডিআরবি কলেরা প্রতিরোধক ওরস্যালাইন আবিষ্কার করেছে। অন্য কোনো চিকিৎসা সংস্থা কি মিথ্যা কথন রোগ মুক্তির ওষুধ আবিষ্কার করতে পারবে?
আরেকটা ছক্কা মারলেন খালেদা।
পঞ্চম ওভারে আলোচিত হয় সময়সীমা নিয়ে। হাসিনা মনে করিয়ে দেন খালেদা দুই দিন সময় দিয়েছিলেন আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার জন্য। খালেদার ব্যাটিং এই পর্যায়ে সময়সীমা বিষয়ে দুর্বল কিন্তু ধর্মীয় প্রসঙ্গে খালেদা শক্তভাবে ব্যাট করেন।
হাসিনা : আপনি কালকে বললেন ...
খালেদা : না, আমি কর্মসূচি দিয়ে ফেলেছি। এখন সম্ভব না।
হাসিনা : আপনি নিজেই বলেছেন, দুই দিনের মধ্যে আলোচনার জন্য না ডাকলে হরতাল দেবেন।
খালেদা : আমি হরতাল দিয়ে ফেলেছি। আগে বলা উচিত ছিল।
হাসিনা : আপনি আপনার বক্তব্যটা আবার শোনেন।
খালেদা : হ্যা, এখন আমি নিজে শুনলেও কর্মসূচি দিয়ে ফেলেছি। সঙ্গে সঙ্গেই বলেছি, কর্মসূচিও চলবে, আলোচনাও চলবে।
হাসিনা : আপনি যেহেতু বললেন দুই দিনের মধ্যে ...
খালেদা : আমি বলেছি। কর্মসূচি-সংলাপ একসঙ্গে চলবে।
হাসিনা : এর আগেই আমি ফোন করলাম।
খালেদা : না, হরতাল চলবে। কর্মসূচি ঠিক হয়ে গেছে। ১৮ দলের সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১৮ দল পাব কোথায় এখন? এখন কেউ নেই।
হাসিনা : ১৮ দল আপনি পাবেন, ডাকলেই পাবেন। আপনি ডাকলে হবে না, এটা কোনো কথা হলো নাকি। এটা কেউ বিশ্বাস করবে না।
খালেদা : বিশ্বাস করবে না ঠিক আছে। আগে ডাকলে হতো। কিন্তু এখন হবে না, এই কারণে ...
হাসিনা : আপনি বললেন, দুই দিনের মধ্যে আলোচনা না করলে আপনি হরতাল দেবেন। এ সময়ের মধ্যেই আপনাকে ফোন করলাম।
খালেদা : না, আপনি যদি কাল রাতেও ফোন করতেন, তাহলে কর্মসূচি বিবেচনা করা যেত। পুরো রাত চলে গেছে। সকালে অফিসে চলে গেছি।
হাসিনা : রাতে ফোন না দিলে তো আপনার হয় না। আমি রাত জাগি না।
খালেদা : আপনি কি সন্ধ্যার সময় ঘুমিয়ে পড়েন?
হাসিনা : আমি তো নামাজ পড়ি ... কোরআন তেলাওয়াত করি।
খালেদা : আমি জানি। আপনি খুব নামাজ পড়েন, কোরআন তেলাওয়াত করেন, আবার হুজুরও মারেন। সব কিছুই করেন।
হাসিনা : আপনারা কি করেন সেটাও সবাই জানে। কোরআন পোড়ান, মসজিদে আগুন দেন।
খালেদা : কোরআন শরিফ আপনারা পুড়িয়েছেন। কারণ এগুলো আপনারা বিশ্বাস করেন না। ২৯ অক্টোবরের পরে তারিখ দেন। এরপরে যদি চান আলোচনা হবে। এর আগে আলোচনার সুযোগ নেই।
হাসিনা : আপনি যে সময়সীমা বেধে দিয়েছিলেন আমি ঠিক সেই সময়ের মধ্যেই আপনাকে ফোন করেছি আলোচনার জন্য।
খালেদা : এখন আমার দলের কোনো নেতাকে পাব না। স্ট্যান্ডিং কমিটির নেতাদের পাব না। ১৮ দলের নেতাদের পাব না। কার সাথে কথা বলে আমি এটা প্রত্যাহার করব, আপনি বলেন? হাসিনা : আপনি কাউকে পাবেন না, এটা একটা কথা হলো? আপনি হুকুম দিলেই তো সব হবে।
খালেদা : আরে, আপনার ডিবি, এসবি তো আমার বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছে। আমার নেতারা কি করে আসবে বলেন?
হাসিনা : আপনারা ছুরি-কাচি-দা-কুড়াল নিয়ে মানুষকে আক্রমণ করার কথা বলছেন।
খালেদা : ছুরি-কাচি-দা-কুড়াল নিয়ে তো আপনারা করেন। বিশ্বজিৎকে আপনার লোকজন দা দিয়ে হত্যা করল না? আমরা ২৯ তারিখের আগে যেতে পারব না।
হাসিনা : আমার লোকজন না। যারা করেছে তারা অনেক আগে থেকেই বহিষ্কৃত। আমরা তাদের সবাইকে গ্রেফতার করেছি। তাদের বিচারও হচ্ছে।
খালেদা : যাদের দেখা গেছে তাদের গ্রেফতার করা হয়নি। সব নিরীহ মানুষকে ধরেন যদি তাহলে তো হবেই।
হাসিনা : তাদের গ্রেফতার করে দেখা গেছে তাদের মা-বাবা কেউ জামায়াত করে, কেউ বিএনপি করে।
খালেদা : না। তারা ছাত্রলীগ করে এবং ছাত্রলীগই করে। আমি আপনাকে আবারও রিকোয়েস্ট করছি, ২৯ তারিখের পরে যদি আলোচনা করতে চান, তাহলে যেকোনো দিন দেন। আমরা রাজি আছি। এখন এই কর্মসূচি থেকে বেরোনোর কোনো পথ নেই। আপনি ৩০ তারিখে ডাকেন, আমি যাব।
হাসিনা : আপনি জনগণের সামনে, জাতির সামনে যে বক্তব্যটা দিয়েছেন, সেটা অনুসরণ করেন। হরতাল প্রত্যাহার করেন।
খালেদা : সেটা করার পথ আর খোলা নেই এখন। টাইম ওভার হয়ে গেছে। আপনি যদি কাল রাতেও ফোন করতেন, আমি রাতেই মিটিং ডাকতাম।
পাঠকরা লক্ষ্য করবেন, হাসিনা অপ্রাসঙ্গিকভাবে দেশবাসীকে জানাতে চেয়েছেন তিনি মুসলমান, নামাজ পড়েন, কোরআন তেলাওয়াত করেন।
তার মনেই কি সন্দেহ আছে যে তিনি মুসলমান নন?
বারবার কেন তিনি প্রমাণ করতে চান ধর্মীয়ভাবে তিনি একজন মুসলমান?
পরিহাস এই যে, শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ, যেটি অতীতে ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ, এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মুসলিম বিদ্বেষী দল রূপে পরিচিত। হাসিনা সরকার ৬ মে ভোর রাতে নিরস্ত্র, নিষ্পাপ ও ধর্মপরায়ণ মুসলিমদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। শেখ হাসিনা তাদের নিয়ে বিদ্রুপ করেছেন। বলা হয়েছে শাপলা চত্বরে কেউ হতাহত হয়নি। সেখানে শরীরে রং মেখে মানুষ পড়ে ছিল। পাখি হয়ে ফুরুৎ করে আকাশে উড়ে গিয়েছে।
পাঠকদের জানা উচিত যে, হাসিনা-খালেদার সংলাপের এই অংশের কিছুটা, প্রথম আলো ও অন্যান্য পত্রিকা চেপে গিয়েছে। হাসিনা যে মুসলিম ধর্ম নিয়ে দ্বৈত আচরণ করেন সেটা যেন ধরা না পড়ে সে বিষয়ে এসব পত্রিকা সতর্ক ছিল।
এখানে আরো লক্ষণীয় যে, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড সংশ্লিষ্টদের সম্পর্কে হাসিনা বলেন, তারা ছাত্রলীগের নয় এবং তাদের বাবা-মা ছিল জামায়াত-বিএনপি পন্থী।
খালেদা মনে করিয়ে দিতে পারতেন হাসিনাকে যে তার পিতা শেখ মুজিব প্রথমে ছিলেন পাকিস্তানি। হাসিনার উৎসাহে প্রকাশিত তার পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে প্রতিষ্ঠিত হয় যে শেখ মুজিব তার রাজনীতির অধিকাংশ জীবনে ছিলেন পাকিস্তানে বিশ্বাসী একজন নেতা। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়েছিল ১৯২০-এ এবং ১৯৭০ পর্যন্ত তিনি ছিলেন পাকিস্তানি নেতা। জীবনের শেষ সময়ে সাড়ে চার বছর তিনি ছিলেন বাংলাদেশি নেতা। তাহলে বংশানুক্রমিকভাবে হাসিনাও কি পাকিস্তানে বিশ্বাসী? যেমনটা তিনি বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের সম্পর্কে বলেছেন?
খালেদার দুই রান।
ষষ্ঠ ওভারে হাসিনা আরো দুটি মিথ্যা বলেন এবং ধরা পড়ে যান।
হাসিনা : আপনি দুই দিন সময় দিয়েছিলেন। আমি দুই দিনের মধ্যেই আপনাকে ফোন করেছি।
খালেদা : আপনি কি মনে করছেন এই হরতালেই আমাদের কর্মসূচি শেষ হয়ে যাবে!
হাসিনা : না, না। আপনি তো আরও হরতাল দেবেন। আপনি ৩৩০ দিন হরতাল দিয়েছিলেন। সেটা তো আমার মনে আছে।
খালেদা : ৩৩০ দিন দিইনি কিন্তু। আপনি ১৭৩ দিন হরতাল দিয়েছেন। মনে নেই? আচ্ছা আপনি বলেন, ১৯৯১ সালে আমরা দুজনে আন্দোলন করে গণতন্ত্র আনলাম। তারপরে সেখানে আপনি অপজিশনে গেলেন, তাতে কি আছে? আমরা একসঙ্গে কাজ করতাম। কিন্তু আপনি তো সংসদে ফোরে দাড়িয়ে বললেন এক দিনের জন্য আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না।
হাসিনা : এটা আমি বলিনি। নো।
হাসিনার দুটি মিথ্যা এবং খালেদার পর পর দুটি বাউন্ডারি। আট রান। হাসিনা ৩৩০ দিন হরতালের সংখ্যাটি ম্যানুফ্যাকচার করেন। কিন্তু এই ভেজাল পণ্য তাৎক্ষণিকভাবে খালেদা রিজেক্ট করে দিয়ে ১৭৩ দিন আওয়ামী হরতালের খাটি সত্যটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। সপ্তম ওভারে তিনি এটাও হাসিনাকে মনে করিয়ে দেন যে তার (খালেদার) প্রথম মেয়াদের সূচনায় হাসিনা কি বলেছিলেন।
খালেদা : এগুলোর তো রেকর্ড আছে। আর তত্ত্বাবধায়ক? তত্ত্বাবধায়ক তখন কার ছিল? জামায়াতের ছিল। আপনি তখন তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া মানবেনই না।
হাসিনা : তখন মাগুরার ইলেকশন ...
খালেদা : আরে, মাগুরার ইলেকশন? ভোলার ইলেকশন আপনি বলেন না কেন?
হাসিনা : ভোলার ইলেকশনের পরে যে সিচুয়েশন তৈরি হয় তখন উপায় ছিল কি? ওইভাবে ভোট কারচুপি করলে ...
খালেদা : এই সিচুয়েশন এখনো হয়েছে। আপনার পক্ষে আপনার ডিসি ভোট চেয়ে বেড়ায়। ডিসি নৌকায় ভোট চেয়ে বেড়ায়।
হাসিনা : ডিসি কি কথা বলছে আর পত্রিকা কি কথা বলছে ...
খালেদা : না। এগুলো ঠিক তো। আপনি কালকে ডিসিকে বলবেন ব্যালট বাক্স ভর্তি করো। নো। এগুলো হতে পারে না। আপনি যদি ৩০ তারিখে করতে চান আমি রাজি আছি। আমার এটা ফাইনাল। এর বাইরে আমি যেতে পারি না।
হাসিনা : না না। ডিসিরা ভোট চাইবে কি জন্য।
খালেদা : চেয়েছে তো। পত্রিকায় এসেছে তো।
হাসিনা : ভোট চাওয়ার লোকের আমার অভাব নাই। আমার দল তো এ দেশে সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই জন্ম নিয়েছে।
খালেদা : আমার দলও অনেক সংগ্রাম করে ক্ষমতায় এসেছে। এগুলো কথা বললে কথার পিঠে কথা আসবেই।
হাসিনা : আমি আবারও আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি হরতালটা প্রত্যাহার করেন।
খালেদা : আমি হরতাল প্রত্যাহার করতে পারব না। আপনি সময়মতো আমাকে টেলিফোন করেননি। সে জন্য আমি দুঃখিত। কালকে যদি টেলিফোন করতেন পরিবেশ পরিস্থিতি অন্যরকম হতো।
হাসিনা : আপনি কালকেই তো আলটিমেটাম দিলেন। কালকে একটার দিকেই তো আপনাকে ফোন করেছি। তা-ও পাইনি। আপনি বলছেন ফোন বাজছে না। কিন্তু আমার যে এডিসি দেড়টা পৌনে দুইটা থেকে চেষ্টা করেছে।
খালেদা : ফোন না বাজলে তো আমার কিছু করার নেই। আমি তো বলেছিলাম নয়টার সময় নেতাদের ডাকব, কথা বলব, তখনো তো আমাকে ফোন দিলেন না ...
হাসিনা : আমার জরুরি মিটিং ছিল। কোনো মিটিংয়ে আমি দেরি করতে পছন্দ করি না। অলরেডি দেরি হয়ে গিয়েছিল।
খালেদা : আপনি যদি মনে করেন ওই মিটিং বেশি ইমপরটেন্ট, না এটা বেশি ইমপরটেন্ট।
হাসিনা : না। সব মিটিংই তো ইমপরটেন্ট। আমার কথা বলার পর আপনি ১২টার দিকে নেতাদের সঙ্গে বসে হরতালটা প্রত্যাহার করে নিতেন।
খালেদা : মিটিং থেকে বের হয়েও আপনি কথা বলতে পারতেন। তাহলে আমার তখন সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো।
হাসিনাকে অষ্টম ওভারে খালেদা মনে করিয়ে দেন অতীতে জামায়াতের সঙ্গে মিলেমিশে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। তখন খালেদার সরকার নির্বাচিত সরকার হলেও হাসিনা সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন চাননি। এখন ডিসিদের মাধ্যমে হাসিনা যে কিভাবে ভোট ম্যানিপুলেট করবেন সেটাও স্পষ্ট বলে দেন খালেদা।
আলোচনার এই অংশে যখন আরেকটি ইমপরটেন্ট মিটিং ছিল বলে হাসিনা জানান, তখন খালেদা সংযত ছিলেন। দেশবাসী জানেন, যেকোনো মিটিংয়ের চেয়ে বেশি ইমপরট্যান্ট ছিল এই টেলি আলোচনা। কিন্তু হাসিনা এটাকেও খাটো করতে চেয়েছেন।
ব্যাড বোলিং।
এই সময়ে হাসিনা জানতেন না যে খালেদা তার এই দুর্বলতার সুযোগ একটু পরেই নেবেন।
হাসিনা : আপনি দয়া করে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেন।
খালেদা : এককভাবে আমি কিভাবে সিদ্ধান্ত নেব?
হাসিনা : আপনি বলেন যে, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি। সে অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আপনি হরতালটা প্রত্যাহার করছেন। সে কথা জনগণের সামনে বলেন।
খালেদা : না, সেটা তো হবে না। তাহলে আপনি বলবেন যে, আপনি নির্দলীয় সরকার মেনে নেবেন। তাহলে আমি হরতাল উইথড্র করব।
হাসিনা : তাহলে আর আলোচনার কি থাকল?
খালেদা : নো। আলোচনার অনেক থাকে। আলোচনার অনেক প্রক্রিয়া থাকে। আপনি বলেন যে, আমি নির্দলীয় সরকার মেনে নেব। তাহলে আমি হরতাল উইথড্র করব।
হাসিনা : আমার ৯০ ভাগ সিট থাকা সত্ত্বেও আমি আপনাকে আহ্বান জানাচ্ছি সর্বদলীয় সরকার করার জন্য।
খালেদা : সর্বদলীয় সরকার হয় না। আপনি এর আগেও বলেছেন। সেগুলো হতে পারে না। আপনি যদি বলেন যে, এখন আপনি নিরপেক্ষ সরকারের জন্য রাজি আছেন তাহলে আমি হরতাল উইথড্র করে নেব। আপনি বলেন।
হাসিনা : যারা মাইনাস টু করতে চেয়েছিল, তাদের আবার সুযোগ দিতে চান কেন?
খালেদা : আমি দিতে চাই না। সেটা আপনি দিতে চান। আপনি যে ভাষায় কথা বলেন।
হাসিনা : না আপনি তো খুব মধুর ভাষায় কথা বলছেন।
খালেদা : আপনি যে ভাষায় কথা বলেন সে জন্য আমরা আপনার বক্তব্য শুনিই না।
হাসিনা : আমরা যেটা চাচ্ছি যে, পার্লামেন্টে আমরা আছি। পার্লামেন্টে আমরা যেহেতু আছি, কখনো আপনি অপজিশনে কখনো আমি অপজিশনে। কখনো আমি সরকারে কখনো আপনি সরকারে। আমরা যা করব পার্লামেন্টের ভেতরেই করব।
খালেদা : না। না। আপনার মিটিংয়ের সময় তো আপনি নষ্ট করছেন। আপনার মিটিংয়ের টাইম তো আমি নষ্ট করতে চাই না। আপনার তো মিটিংয়ে যাওয়ার কথা। আপনি দেরি করছেন তো। আপনার মিটিংয়ের দেরি আমি করতে চাচ্ছি না। এভাবে সব কথা হয় না।
নবম ওভারে খালেদা কান্ত হয়ে পড়েন। তিনি সিদ্ধান্তে আসেন কোনো আলোচনার জন্য নয়, হরতাল বন্ধ করার জন্য ফোন করেছেন হাসিনা। তাই তিনি আলোচনা শেষ করার জন্য হাসিনাকে মনে করিয়ে দেন তার (হাসিনার) মিটিংয়ের কথা।
সুপার ব্যাটিং। ছক্কা।
আলোচনার এই অংশে কুমির বাহিনীর প্রতি হাসিনার বীতশ্রদ্ধা ফুটে ওঠে। তিনি মাইনাস টু-কারীদের বিরুদ্ধে বলেন। যদিও এই কুমির বাহিনীকে তিনি প্রচুর প্রলোভন-প্রমোশন-অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে আওয়ামী অনুগত করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন, বিশেষত গত এক বছরে।
হাসিনা : হরতালটা উইথড্র করে দেন।
খালেদা : না, আপনি বলেন আগে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। এটা নিয়ে আলোচনা হবে। তাহলে আমি হরতাল উইথড্র করে নেব।
হাসিনা : এটা নিয়ে তো যখন কথা হবে তখন আলোচনা হবে আপনাদের সঙ্গে।
খালেদা : আলোচনা তো কোন কোন ব্যক্তি নিরপেক্ষ হবে, নির্দলীয় কিভাবে হবে, আপনার ফর্মুলা থাকবে না আমার ফর্মুলা থাকবে, এগুলো নিয়ে তো আরো অনেক আলোচনা বাকি আছে।
হাসিনা : আপনি নিজের দলের লোকের ওপর ভরসা করেন না।
খালেদা : আমার দলের লোকের ওপর আমার ভরসা আছে। আপনি যদি বলেন যে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে রাজি আছেন, তাহলে কালকেই আমি হরতাল উইথড্র করে দেব। রাতের মধ্যে ঘোষণা দিয়ে দেব হরতাল উইথড্র হবে। আমরা কালকেই আপনার সঙ্গে আলোচনায় বসব। কোনো অসুবিধা নেই। আপনি শুধু এটুকু বলেন।
হাসিনা : আপনি সর্বদলীয়টা মেনে নেন।
খালেদা : না। সর্বদলীয় মানা যায় না। সর্বদলীয় মানা যায় না।
হাসিনা : পরে আবার কাকে আনবেন ফখরুদ্দীন, মইনউদ্দিন হয়ে যাবে। আপনি আর ফখরুদ্দীন, মইনউদ্দিন সৃষ্টি করবেন না। বরং যা করি আমরা নিজেরা নিজেরা করি।
খালেদা : আমি কিছুই করতে চাই না। আপনি নির্দলীয় সরকারে রাজি হলে বলেন, না হলে আপনি ৩০ তারিখের পরে ডেট দেন। আমি করব। হরতাল প্রত্যাহার হবে না। ২৯ তারিখের পরে ডেট দেন। আমি আলোচনা করব। হাসিনা : আমি ২৮ তারিখে আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি। আপনি আসেন।
খালেদা : আমি ২৮ তারিখে যেতে পারব না। হরতালের মধ্যে আমি কোথাও যাই না।
হাসিনা : কাদেরকে আনবেন বলেন। আপনি ২৮ তারিখে আসেন (পাশ থেকে কেউ শেখ হাসিনাকে কিছু বলে দিচ্ছিলেন)।
খালেদা : ২৮ তারিখে আমি যাব না। আপনাকে কে ওখান থেকে প্রম্পট করছে? হরতাল প্রত্যাহার হবে না। আপনি যদি ৩০ তারিখে রাজি থাকেন ...
হাসিনা : ধন্যবাদ। আপনি ভালো থাকেন।
দশম বা ফাইনাল ওভারে হাসিনা আবার ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের ভয় দেখান খালেদাকে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উচিত হাসিনার এই মানসিকতাকে জানা এবং বুঝা। খালেদা ওই ভয়ভীতিকে কোনো পাত্তা না দিয়ে, এক. নিজের দলের মানুষদের প্রতি অটল আস্থা প্রকাশ করেন, দুই. এককভাবে নয় তার দলের সবাইকে নিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করেন এবং তিন. টানা ৬০ ঘণ্টার হরতাল প্রত্যাহারে সংকল্পবদ্ধ থাকলেও ৩০ অক্টোবরে অথবা তার পরে অন্য কোনো দিনে আলোচনায় রাজি থাকার বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করেন।
ছক্কা।
হাসিনার বোলিং হয় ব্যর্থ। হাসিনার নাটক হয় ফপ।
এই টেলি সংলাপের নেট রেজাল্ট কি হবে তুমি মনে করো? বিএনপির মধ্যে? শামীম প্রশ্ন করল শরিফকে।
খালেদার প্রতি ১৮ দলীয় জোটের মধ্যে আস্থা আরো উজ্জীবিত হবে। তিনি যে আওয়ামী লীগের ফাদে পা দেননি, আন্দোলন থেকে সরে আসেননি Ñ বরং বলেছেন, আলোচনা এবং আন্দোলন একই সঙ্গে চলবে, এটা নেতা-কর্মীদের আশ্বস্ত করবে। জোটের মধ্যে বিএনপির সহযাত্রীরা লক্ষ্য করবেন খালেদা তাদের সবার মতামত নিয়ে আলোচনায় থাকতে চান। শেখ হাসিনার ভাষায় খালেদা হুকুম করবেন না। এর ফলে জোটের মধ্যে খালেদার গণতান্ত্রিক অবস্থান সংহত হয়েছে। শরিফ উত্তর দিল।
আর আওয়ামী লীগের মধ্যে?
আওয়ামী লীগ প্রথমে মনে করবে এই টেলি সংলাপের ফলে খালেদা উত্তেজিত, একরোখা এবং অসহিষ্ণু রূপে প্রমাণিত হবেন। অন্য দিকে তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ধৈর্যশীল সমঝোতাকামী এবং নমনীয় রূপে আবির্ভূত হবেন। তাই আওয়ামী লীগ চাইবে এই টেলি সংলাপের পূর্ণ বিবরণ মিডিয়াতে প্রকাশ করতে। তথ্য মন্ত্রী ইনু সেদিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু পরে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারবে। তারা বুঝতে পারবে প্রতিটি পয়েন্টে খালেদা তাৎক্ষণিক উত্তরে সত্য কথাগুলোই বলেছেন এবং হাসিনার যেসব সমালোচনা তার দলের মধ্যেও হয়, সে বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। তখন আওয়ামী লীগ চাইবে এই টেলি সংলাপ প্রকাশের দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে। সংলাপ প্রকাশ হয়ে গেলে তার দায়-দায়িত্ব বিএনপির ওপর চাপিয়ে দেয় তারা । আওয়ামী লীগ তখন আরেকটা ভুল করবে। শরিফ বলল।
সার্বিকভাবে কি প্রতিক্রিয়া হবে?
অধিকাংশ মানুষই হতাশ হবে। তারা বুঝবে টেলি সংলাপে সংকট সমাধানে আলোচনা বিষয়ে নয়Ñ হরতাল বানচালে হাসিনা এই টিভি শো করেছিলেন। তারা বুঝবে সংগত কারণে খালেদা উত্তেজিত এবং আক্রমণাত্মক ছিলেনÑ খালেদা আন্তরিকভাবেই সংকট সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনা চেয়েছিলেন এবং এখনো তাই চান। হাসিনা প্রস্তাব দিয়েছেন সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। খালেদা চেয়েছেন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। সুতরাং বলা যায়, দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা শেষ হয়ে গিয়েছে। দুই নেত্রী যা বলার বলে দিয়েছেন। এর পরও কেনো তৃতীয় পক্ষের আগ্রহ এবং মধ্যস্থতায় দুই নেত্রী যদি কোনো আলোচনা করেন সেটা হতে হবে চূড়ান্ত গোপনীয়তা রক্ষার শর্তে। যদিও কেউই হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। রাষ্ট্রীয় খরচে ফালতু নৈশভোজে নয়Ñ ওই আলোচনা দিনের বেলায় অফিসের সময়ে হওয়া উচিত হবে। উভয় পক্ষের সময় মেনে চলার দায়িত্বে থাকতে হবে মধ্যস্থতাকারীকে। এই ধরনের আনুষ্ঠানিক, অপ্রকাশ্য কিন্তু ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজ করতে হবে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। শরিফ বলল।
আমাদের এই রচনার মধ্যে রিলিফ হিসেবে কার্টুন যাবে। খালেদা ব্যাট করছেন, হাসিনা বল করছেন, মহসিন, এমন একটা কার্টুন তুমি একে ফেল। আমাকে দেখিও। শামীম বলল।
খালেদা জিয়ার রেড টেলিফোন বিষয়ে শেখ হাসিনার কৌতূহল বহু বছরের। অতীতে হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি তার রেড টেলিফোনে পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেয়েছি।’ তার এই মন্তব্যের কারণ বোধ হয় ছিল, তিনি মনে করেন কোনো নারীর জন্য বরাদ্দকৃত রেড টেলিফোনে কোনো পুরুষের কণ্ঠস্বর শোনাটা অবাঞ্ছিত।
টিভিতে দেখা গেছে গুলশানে খালেদার বাসভবনের দোতলায় ড্রয়িংরুমে তিনি যে সোফায় বসে ছিলেন তার ঠিক উল্টো দিকে ছিল রেড টেলিফোন। সেই টেলিফোনের পাশের সোফায় বসে ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল পুরুষ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মাঝখানের সোফায় বসে ছিলেন খালেদার প্রেস সচিব পুরুষ মারুফ কামাল খান। এ ছাড়াও ওই ড্রয়িংরুমে উপস্থিত ছিলেন খালেদার বিশেষ সহকারী পুরুষ শামসুর রহমান শিমূল বিশ্বাস ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান পুরুষ শমসের মবিন চৌধুরী। সংলাপের সময়ে নীরব ছিলেন এই চার পুরুষ। রেড টেলিফোন বিকল ছিল। শেষ অবধি শিমূল বিশ্বাসের মোবাইল ফোনে হাসিনার এডিসির মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কল দেন সন্ধ্যা ছ’টা একুশে। সাইত্রিশ মিনিট কথা শেষের পর হাসিনা দাবি করেননি যে তিনি পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেয়েছেন। সংলাপকালীন খালেদার ড্রয়িংরুমের ছবি অল্প সময় দেখানো হয়। সেই ছবিতে দেখানো হয় একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের কর্মী রেড টেলিফোন পরীক্ষা করছেন। যাই হোক। মোট কথা হলো, এই আলোচনার বিশাল গুরুত্ব বুঝে খালেদা মাত্র চারজনকে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হতে বলেছিলেন। খালেদা এই আলোচনাকে কোনো নির্বাচনী ফটো অপরচুনিটি রূপে মনে করে
টিভি ক্যামেরা বাহিনীকে সেখানে উপস্থিত হতে বলেননি।
অন্যদিকে গণভবনে শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য পুরুষ আমির হোসেন আমু ও পুরুষ তোফায়েল আহমদ, উপদেষ্টা পুরুষ এইচ টি ইমাম, উপদেষ্টা পুরুষ ড. মসিউর রহমান, প্রেসিডিয়াম সদস্য পুরুষ কাজী জাফর উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক পুরুষ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা পুরুষ ইকবাল সোবহান চৌধুরী, উপদেষ্টা পুরুষ ড. মোদাচ্ছের আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক পুরুষ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক পুরুষ বদিউজ্জামান ভূইয়া প্রমুখ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী নারী ডা. দীপু মনি। অর্থাৎ দশ পুরুষ ও এক নারী। সেখানে টিভি ক্যামেরা ছিল। স্টিল ক্যামেরা অনবরত ফ্যাশ করছিল। প্রশ্ন হচ্ছে এতজনের উপস্থিতি কি আদৌ দরকার ছিল? খালেদার মতো দলের সাধারণ সম্পাদক, সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং তথ্য উপদেষ্টাসহ কোনো এক সহকারীর উপস্থিতিই কি যথেষ্ট ছিল না? এটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে দলবল নিয়ে ফটো অপরচুনিটির আয়োজন কেন হাসিনা করেছিলেন? হাসিনা-খালেদার আলোচনা তো ভাবগম্ভীর পরিবেশে হওয়া উচিত ছিল। খালেদা বুঝেছিলেন এই আলোচনার আনুষ্ঠানিকতা, ফর্মালিটি, প্রটোকল। হাসিনা এটা বুঝতে চাননি। চিফ রিপোর্টার ফয়েজ বলল।
তুমি হেডকাউন্ট করছ কেন? জেনডার কাউন্ট করছ কেন? শামীম জিজ্ঞাসা করল।
হেডকাউন্ট করছি এটা বোঝাতে যে খালেদার তুলনায় হাসিনা ডাবলেরও বেশি মানুষ তার পাশে রেখে একটা টিভি শো-র ব্যবস্থা করেছিলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ যখন ইরাক যুদ্ধ সংকট নিয়ে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে ফোন করেছিলেন, তখন তাদের দুজনার পাশে এত মানুষ ছিল না এবং সেই সংলাপের কোনো ছবি প্রকাশিত হয়নি। আমি মনে করি দেশের এত বড় সংকটে একটা মিনি হাট বসিয়ে ফটো অপরচুনিটির আয়োজন করে শেখ হাসিনা আলোচনার আনুষ্ঠানিক আবহ তৈরি করেননি। সম্ভবত সেই ইচ্ছাটি তার ছিলও না। সহজ ভাষায় বলা চলে তিনি লোক দেখানো সংলাপের আয়োজন করেছিলেন শুধু হরতাল বানচাল করার লক্ষ্যে। আমু এবং তোফায়েল গত পাচ বছর যাবৎ হাসিনার আশীর্বাদ বঞ্চিত হলেও এই আলাপের সময় কেন সেখানে থাকার আমন্ত্রণ পেলেন সেটাও বোঝা যায়নি। আর জেনডার কাউন্ট করলাম এটা বোঝাতে যে রেড টেলিফোনের পাশে সংগত কারণেই পুরুষের উপস্থিতি ঘটতে পারে। শেখ হাসিনার ওই রুমে নিশ্চয়ই একটা রেড টেলিফোন ছিল, যেখান থেকে তিনি খালেদাকে ফোন করতে চেয়েছিলেন। সেই রুমে এত প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় পুরুষের উপস্থিতি যে ছিল সেটা রেকর্ড করে রাখা উচিত। ফয়েজ আরো বলল।
আশ্চর্যের কথা এই যে, ১৩৭ বছর আগে ১০ মার্চ ১৮৭৬ আমেরিকায় বস্টন নিবাসী অ্যালেকজান্ডার গ্রেহাম বেল একটি অনির্ধারিত সংলাপ দিয়ে বিশ্বের সর্বপ্রথম ফোনালাপটি করেছিলেন এবং টেলিফোন আবিষ্কার যে করেছেন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। সেদিন ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে গিয়ে গ্রেহাম বেল-এর শরীরে ব্যাটারি এসিড ছিটকে পড়ে। তিনি টেলিফোনে বলেন, ‘মি. ওয়াটসন, কাম হিয়ার, আই ওয়ান্ট ইউ।’ তার অ্যাসিসট্যান্ট ওয়াটসন ছিলেন পাশের রুমে। তিনি দ্রুত দৌড়ে আসেন। এই দুর্ঘটনা সামলাতে গিয়ে তারা দুজন বুঝতে পারেন, যে যন্ত্রটি আবিষ্কারের জন্য দীর্ঘকাল যাবৎ কাজ করছিলেন, অবশেষে সেটি আবিষ্কৃৃত হয়েছে। বৈদ্যুতিক প্রবাহ বা ইলেক্টৃক কারেন্টের মাধ্যমে মানুষের কণ্ঠস্বর এক প্রান্তে পাঠানো সম্ভব এই যন্ত্রে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত বহু মিলিয়ন মানুষ বহু বিলিয়ন টেলিফোনে বহু টৃলিয়ন শব্দ বলেছেন।
টেলিফোন শব্দটি এসেছে দুটি গৃক শব্দ, টেলি এবং ফোন থেকে। টেলি শব্দের অর্থ দূর। ফোন শব্দের অর্থ কণ্ঠস্বর। টেলিফোনের মানে দাড়ায় দূরের কণ্ঠস্বর।
টেলিফোন জয় করেছে দূরত্ব। দূরের মানুষকে এখন নিমেষেই কাছে পাওয়া সম্ভব তার কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে। অথচ মোহাম্মদপুরে অবস্থিত প্রধানমন্ত্রীর গণভবন থেকে মাত্র তিন-চার মাইল দূরে অবস্থিত বিরোধী নেত্রীর বাসভবনে এই একবিংশ শতাব্দিতে নির্ধারিত সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোন করতে পারলেন না! আর কোনো কারণে না হোক, শুধু এই লজ্জাজনক প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর পদ এখনই শেখ হাসিনার ছেড়ে দেওয়া উচিত। মেরি বলল।
আজকাল মোবাইল ফোন কম্পানিগুলো যে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে সেটা দেখলে হাসিনা হয়তো কিছু উন্নতি লাভ করতেন। শামীম বলল।
তার মানে? উপস্থিত সবাই সমস্বরে জানতে চাইল।
গ্রামীণফোন বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ‘চলো বহু দূর’। ওই বিজ্ঞাপনে দেখা যায় আকাশ ছোয়া এক ভবন থেকে অনন্ত জলিল অনন্ত আকাশে লাফ দিচ্ছেন। অভিনেতা অনন্ত জলিল বলেন, ‘অসম্ভবকে সম্ভব করাই অনন্তর কাজ।’ শেখ হাসিনা তার পুত্র জয় দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে কোনো আমেরিকান কনসালটেন্টের উপদেশ নয়Ñ বাংলাদেশী অনন্ত জলিলের উপদেশ নিয়ে হয়তো অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারতেন। শামীম বলল।
না। এই সংলাপে বোঝা গেছে হাসিনা চতুর। তিনি দেশ জুড়ে বিলবোর্ড লাগালেও নিজে বিজ্ঞাপনে ভুলবেন না। অনন্তর মতো অনন্ত আকাশে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করবেন না। আর প্রিসাইসলি সেই কারনেই তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে রাজি হবেন না। মেরি বলল।
কিন্তু খালেদা জিয়া অনুসরণ করেছেন অন্য তিনটি টিভি কম্পানির স্লোগান, এয়ারটেল-এর ‘এক টাকার কথায়, এক টাকা ফেরত’-এর মতো তিনি হাসিনার কথার পিষ্ঠে তাৎক্ষণিক কথা বলেছেন। তার আই কিউ যে বেশি সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন। বাংলালিংকের বিজ্ঞাপনী স্লোগান এখন ‘নতুন কিছু করো।’ খালেদা জিয়া তার সংলাপে নতুন দিনের দিকে এগোনোর ডাক দিয়েছেন। তিনি তার আধুনিকতা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
সবশেষে তিনি রবি’র বিজ্ঞাপনী স্লোগান ‘জ্বলে উঠুন আপন শক্তিতে’ অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তার কোনো পুরুষ বা নারীর প্রম্পটিং দরকার হয়নি। তিনি আপন শক্তিতে একাই ব্যাট করে গিয়েছেন। ইনডিয়াতে ব্যাটসম্যান শচীন টেনডুলকার রিটায়ার করছেন। কিন্তু বাংলাদেশে খালেদা জিয়া জ্বলে উঠেছেন। শামীম বলল।
আমি রিপোর্ট পেয়েছি খালেদা যে নৈশভোজে যাননি তাতে আওয়ামী লীগের অনেকে হাফ ছেড়ে বেচেছেন। তারা জানেন রান্না পারদর্শী টমি মিয়া’র সার্টিফিকেট এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা সংগ্রহ করতে পারেননি। হাসিনা ভালো রাধুনি কি না তা নিয়ে সবার সংশয় আছে। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া নৈশ ভোজে এসে খারাপ রান্না খেলে তিন দিনের হরতালের বদলে ছয় দিনের হরতাল হয়তো ডেকে দিতেন। মেরি হাসল।
শেখ হাসিনার ওপর তাহলে কি কারোই আস্থা নেই? শরিফ বলল।
আছে। পাশের দেশের। সম্ভবত সেই শক্তিতেই তিনি জ্বলছেন এবং দেশবাসীকে জ্বালাচ্ছেন। শামীম বলল।
৩১ অক্টোবর ২০১৩
fb.com/ShafikRehmanPresents
No comments:
Post a Comment