গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরেছে মহাজোট সরকার। তাদের পুরো ৫ বছরেই গেছে সাংবাদিক নির্যাতন আর মিডিয়া দলনের মাধ্যমে। সংবাদপত্র দলনে জঘন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে এই সরকার। চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনিসহ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ১৯ সাংবাদিক। বিরোধী মতের সাংবাদিকদের শুধু হামলা-মামলা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, মধ্যরাতে শত শত পুলিশ পত্রিকা অফিস ঘেরাও করে সাংবাদিকদের মারধর, সম্পাদককে গ্রেফতার, রিমান্ডে নেয়া, মাসের পর মাস জেলে পুরে রাখা, পত্রিকা ও টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া এবং বিনা অজুহাতে প্রেস সিলগালা করাসহ হেন অপকর্ম নেই, যা এই সরকারের আমলে হয়নি। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন, চ্যানেল ওয়ান ও অনলাইন পত্রিকা শীর্ষ নিউজ ও শীর্ষ কাগজ। আসতে দেয়া হয়নি যমুনা টেলিভিশনকে। দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দুই দফায় গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে ৬৮টি সাজানো ও মিথ্যা মামলা। প্রথম দফায় ১০ মাস এবং দ্বিতীয় দফায় বিগত ৬ মাসের বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন তিনি। দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদকেও গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে শীর্ষ কাগজ ও শীর্ষ নিউজ ডটকম সম্পাদক একরামুল হককে। তার বিরুদ্ধেও দেয়া হয় বেশ কয়েকটি সাজানো মামলা। এছাড়া ফেসবুক বন্ধ করা, সরকারের সমালোচনা করে এমন ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ করা কিংবা বিটিআরসির মাধ্যমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ সাংবাদিক নির্যাতন এবং মিডিয়া দলনের নয়া রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের ক্যাডার বাহিনীর হামলার শিকার হয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে বহু সাংবাদিককে। এছাড়া পত্রিকা বিলি করতে না দেয়া, পত্রিকায় অগ্নিসংযোগ, এজেন্টদের দোকানে অগ্নিসংযোগ, পত্রিকা ছিনিয়ে নেয়া, এজেন্ট ও হকারদের মারধরসহ মিডিয়া দলনে অসংখ্য নিকৃষ্ট স্থাপন করেছে এই সরকার। দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি অতি উত্সাহী পুলিশ সদস্যরাও এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল না। তারা সরকরি দলের নেতাদের খুশি করার জন্য নিজেরাই বাদী খুঁজে খুঁজে এনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছেন। মামলা করেছে মন্ত্রী-এমপিদের চেলা-চামুণ্ডারাও। সব মিলিয়ে এই পাঁচ বছর কঠিন সময় পার করেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম।
আওয়ামী লীগের সাংবাদিক নির্যাতন নতুন কিছু নয়। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বাকশাল কায়েমের সময় ১৬ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারের লিফলেট আকারে চারটি সংবাদপত্র রেখে সব জাতীয়, আঞ্চলিক দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। বেকার হয়েছিলেন হাজার হাজার সাংবাদিক। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ১০ সাংবাদিক খুন হন এবং বহু সাংবাদিক হামলা ও নির্যাতনের শিকার হন। ওই সময় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল ট্রাস্ট পরিচালিত পত্রিকা দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস, বিচিত্রা, আনন্দা বিচিত্রাসহ বহু কাগজ। এবারও ক্ষমতায় এসে একই ধরনের নজির স্থাপন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার।
১৯ সাংবাদিক খুন
মহাজোট সরকারের শাসনামলে খুন হয়েছেন ১৯ সাংবাদিক। নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে শুধু সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ দম্পতির নামমাত্র বিচার হয়েছে। বহুল
আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডসহ ১৮টি হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। প্রকৃত আসামিরাও গ্রেফতার হয়নি।
২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক মূলস্রোত পত্রিকার সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদেরই দায়ী করেছেন নিহতের পরিবারের লোকজন। এর আগে ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পত্রিকার কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হয়েছেন সাপ্তাহিক অপরাধ দমন পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক দুর্জয় চৌধুরী দীপু। ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর নরসিংদীতে খুন হন দৈনিক নরসিংদীর বাণী পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার তালহাদ আহমেদ কাবিদ। গত ১১ ফেব্রুয়ারি নিজ ফ্ল্যাটে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি। বহুল আলোচিত সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও মামলার আসামিদের গ্রেফতারে এখনও কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। সারা দেশের মানুষ এখনও উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য জানতে চাইছে। কিন্তু তদন্ত সংস্থা পুলিশ, র্যাব, সিআইডি বরাবরই এ বিষয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
২০১১ সালের ১৬ জুন সারা দেশের সাংবাদিক সমাজ যখন সংবাদপত্রের কালো দিবস পালন করছিল, ঠিক ওই সময়ে যশোরের শার্শা উপজেলায় দৈনিক গ্রামের কাগজের শার্শা প্রতিনিধি জামাল উদ্দিন খুন হন। সরকারি দল আশ্রিত মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সংবাদ লেখায় পুলিশের সহযোগিতায় খুন করা হয় জামাল উদ্দিনকে। তার হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। ২০১১ সালের ১০ জুলাই খুন হয়েছেন হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে দৈনিক বিবিয়ানার স্টাফ রিপোর্টার জুনায়েদ আহমদ জুনেদ। তাকে নৃশংসভাবে খুনের পর লাশ রেললাইনে ফেলে রাখা হয়েছিল। একই বছরের ২৮ জানুয়ারি নয়াপল্টনের বাসায় খুন হওয়া প্রবীণ সাংবাদিক ও দৈনিক জনতার সহসম্পাদক ফরহাদ খাঁ (৬০) ও তার স্ত্রী রহিমা খাঁ (৫৫)। ২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কুকরাইল এলাকায় গলাকেটে হত্যা করা হয় দৈনিক ভোরের ডাকের গোবিন্দগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জুকে। একই বছর ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনি এলাকায় দৈনিক আজকের প্রত্যাশা, সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র ও আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার সাংবাদিক মাহবুব টুটুলকে খুন করা হয়। একই দিন অর্থাত্ ২০১০ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকার উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠের সাংবাদিক আলতাফ হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ২০১০ সালের ৯ মে গুপ্তহত্যার শিকার হন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার সিনিয়র ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম টুটুল। যদিও পুলিশের দাবি টুটুল সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয়েছে। তার হত্যার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হামলার পর ২৮ এপ্রিল নিহত হন সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি সাহসী সাংবাদিক ফতেহ ওসমানী। সরকারি দল-আশ্রিত হওয়ায় ফতেহ ওসমানীর খুনিরা গ্রেফতার হয়নি। ২০০৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন বরিশালের মুলাদী প্রেস ক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক, একই বছর জুলাই মাসে ঢাকার পাক্ষিক মুক্তমনের স্টাফ রিপোর্টার নুরুল ইসলাম ওরফে রানা, আগস্ট মাসে গাজীপুরে ঢাকার সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময়-এর নির্বাহী সম্পাদক এমএম আহসান হাবিব বারী, ডিসেম্বরে রূপগঞ্জে দৈনিক ইনকিলাব সংবাদদাতা ও রূপগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি আবুল হাসান আসিফ খুন হন। যদিও পুলিশ দাবি করেছে আবুল হাসান আসিফ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।
আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমান প্রসঙ্গ
মহাজোট সরকারের আমলে যে মিডিয়াটির সবচেয়ে বেশি টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে যে মিডিয়াটি সর্বাধিক হামলা, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে সেটি হচ্ছে দৈনিক আমার দেশ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নিরপেক্ষ ও সাহসী সংবাদ প্রকাশের কারণে আমার দেশ সরকারের রোষানলে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ইলাহীর বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের খবর পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর থেকে সারা দেশে হামলা চলতে থাকে আমার দেশ-এর ওপর, হতে থাকে সিরিজ মামলা। দুর্নীতি রিপোর্ট করায় সাংবাদিক এম আবদুল্লাহর ওপর রাজধানীর বনানীতে হামলা চালানো হয়। এতে গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ওই রিপোর্টের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৫টি মামলা দেয় সরকারি দল। ২০১০ সালের ১ জুন শত শত সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীর বিক্ষোভ বাধা উপেক্ষা করে সাংবাদিকদের মারধর করে আমার দেশ কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ায় হয় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। তাকে গ্রেফতারের সময় শত শত পুলিশ ঘিরে ফেলে আমার দেশ কার্যালয়। বন্ধ করে দেয়া হয় খাবার পানি সরবরাহ ডিসলাইনসহ সবকিছু। পরদিনই সরকার আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করায় পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা ওই দিনই রাত ১১টায় সিলগালা করে দেয়। ১০ জুন ২০১০ বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চ পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশের পরও সরকার পত্রিকার ছাপাখানা খুলে দেয়নি। এরপর ১৫ জুন, ২০১০ আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগের স্থগিতাদেশ অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা) চার সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন। বন্ধ করার সময় আমার দেশ পত্রিকায় সাত শতাধিক সাংবাদিক ও স্টাফ কর্মরত ছিল।
প্রথম দফায় গ্রেফতারের পর ২ জুন ভোররাত ৪টায় পুলিশ আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় হাসমত আলীর দায়ের করা কথিত মামলায় আমার দেশ পত্রিকা অফিস থেকে গ্রেফতার করে। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের সময় পুলিশকে মারধর ও সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে শতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। মামলায় মাহমুদুর রহমান ছাড়াও আমার দেশ-এর নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, বার্তা সম্পাদক জাহেদ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরী ও সিনিয়র রিপোর্টার আলাউদ্দিন আরিফসহ ৫ জনকে এজহারভুক্ত আসামি করে। পরে এই মামলায় আমার দেশ-এর সব সাংবাদিকের রিমান্ডে নেয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। আমার দেশ সম্পাদককে গ্রেফতারের আগে ২০১০ সালের গত ১ জুন সকাল ৯টায় পত্রিকাটির প্রকাশক মো. হাসমত আলীকে তার শাহজাহানপুরের বাসা থেকে এনএসআই সদস্যরা আটক করে তাদের অফিসে নিয়ে কয়েকটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। পরে জানা যায়, ওই কাগজপত্রে লেখা হয়েছে, তিনি কিছুদিন আগে মাহমুদুর রহমানের কাছে পত্রিকার শেয়ার হস্তান্তর করেছেন। তারপরও মাহমুদুর রহমান প্রকাশক হিসেবে তার নাম ছেপে আসছেন। এ কারণে পত্রিকাটিতে কিছু রিপোর্ট ছাপার অভিযোগে মাহমুদুর রহমানের পাশাপাশি তার বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হচ্ছে। মাহমুদুর রহমান আমার দেশের প্রকাশক হিসেবে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে ২০০৯ সালে একটি আবেদন করেছিলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসন সরকারি নির্দেশে সেই আবেদনটি দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখে পরে বাতিল করে দেয়। পরে হাশমত আলী নিজেই ওই মামলা প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু পুলিশ এর পরও ওই মামলায় আদালতে চার্জশিট দিয়েছে।
প্রথম দফায় অফিস থেকে গ্রেফতারের পর মাহমুদুর রহমানকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করার পর আদালত হাসমত আলীর স্বাক্ষর করা মামলায় তার জামিন মঞ্জুর করেন। তবে পুলিশকে মারধর ও সরকারি কাজে বাধাদানের মামলায় জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন। পুলিশ আদালতের কাছে ৫ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত প্রয়োজনে তিন দিনের মধ্যে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। ২ জুন, ২০১০ মাহমুদুর রহমানকে আদালতে হাজির করার সময় উপস্থিত লোকজন বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। ওই দিনই পুলিশকে মারধর করার জন্য কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয় এবং সেই মামলায় মাহমুদুর রহমানকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে ৭ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে তেজগাঁও থানার মামলায় ৩ দিন এবং কোতোয়ালি থানার মামলায় এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ২০১০ সালের ৬ জুন উত্তরা থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে পুরনো মামলায় মাহমুদুর রহমানকে যুক্ত করা হয় এবং ৭ জুন ২০১০ বিমানবন্দর থানায় তার বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়েই কথিত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে। উত্তরা থানা এবং বিমানবন্দর থানা পুলিশ মামলার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মোট ২০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত ৪ দিন করে আরো ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এর ফলে মাহমুদুর রহমানকে প্রথম দফায় মোট ১২ দিনের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। ২০১০ সালের ৮ জুন মাহমুদুর রহমানকে আদালতে হাজির করা হলে তিনি আদালতে বলেন, ‘আমাকে নির্যাতন করা হয়েছে। আমি খেতে চেয়েছি। কিন্তু খাওয়া-দাওয়া তো দূরে থাক পুলিশ আমাকে এক ফোঁটা পানিও দেয়নি। এ সরকার আমাকে মেরে ফেলবে। আমি আর হয়তো জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারব না।’ ৮ জুন ২০১০-এ কোতোয়ালি থানার রিমান্ড শেষে ৯ জুন মাহমুদুর রহমানকে আদালতে হাজির করা হয় এবং তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ৩ দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়। কিন্তু তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার রিমান্ডে নেয়া হলেও তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্ট থানা হাজতে। ১২ জুন, ২০১০ মাহমুদুর রহমানকে তেজগাঁও থানার মামলায় (২(৬)২০১০) ৩ দিনের রিমান্ড শেষে ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন বাহার রুমীর আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্ট থানা থেকে ১০ জুন ভোররাত পৌনে ২টায় ৫ জন লোক এসে আমার চোখ বেঁধে বিবস্ত্র করে ফেলে এবং অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে কনুই দিয়ে বুকে ও পিঠে জোরে আঘাত করলে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরে এলে দেখি ক্যান্টনমেন্ট থানার সেকেন্ড অফিসারের রুমে শুয়ে আছি।’
পরে উত্তরা থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার দেখানোর মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা ৯ জুন মঞ্জুর করা চার দিনের জন্য রিমান্ডে নেয়ার আবেদন পেশ করলে ম্যাজিস্ট্রেট রাশেদ কবীর কোর্ট হাজতখানা থেকে মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে নেয়ার আদেশ দেন।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ডিবি অফিসে নেয়া হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত ১৬ জুন, ২০১০ তাকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠায় এবং সুচিকিত্সার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়। কারাগারে মাহমুদুর রহমান চরম অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০ জুন, ২০১০ কারাগারে চিকিত্সাধীন মাহমুদুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তখনও তার শরীরে ছিল ব্যাপক নির্যাতনের চিহ্ন। ২০১০ সালের ২৩ জুন সকালে নম্বরপ্লেটবিহীন দুটি গাড়িতে করে ডিবি অফিস থেকে বের করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৪ জুন মাহমুদুর রহমানকে সিএমএম কোর্টে হাজির করা হলে তিনি আদালতে বলেন, তাকে র্যাব-১ কার্যালয়ে নিয়ে সকাল আনুমানিক ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চোখ বেঁধে কবরের মতো একটি ছোট সেলে হাতকড়া পড়িয়ে গ্রিলের সঙ্গে আটকিয়ে রাখা হয়।’ তিনি আদালতকে প্রশ্ন করে বলেন, ‘নির্যাতনের সংজ্ঞা কী?’ এ ছাড়া মাহমুদুর রহমান তার আইনজীবীর কাছে জানান, র্যাব-১ কার্যালয়ে নেয়ার পর তার কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর এবং আঙুলের ছাপ নেয়া হয়। এরপর আদালত মাহমুদুর রহমানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এছাড়া মাহমুদুর রহমানকে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই দুদকের দায়ের করা একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পরে এসব মামলায় তিনি আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।
২০১০ সালের ১৯ আগস্ট সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন নজির সৃষ্টি করে আদালত অবমাননার অভিযোগে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ৬ মাসের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ড দেয়। এছাড়াও প্রতিবেদক অলিউল্লাহ নোমানকে এক মাসের কারাদণ্ড, দশ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৭ দিনের কারাদণ্ড এবং প্রকাশক মো. হাশমত আলীকে দশ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ৭ দিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়। ওই বছরের ২১ এপ্রিল আমার দেশ পত্রিকায় ‘চেম্বার জজ মানেই সরকার পক্ষের স্টে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্যে সুপ্রিমকোর্টের সরকারপন্থী দুই আইনজীবীর করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ ওই দণ্ড দেয়। মামলার শুনানিতে ‘আমার দেশ’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান নিজেই বক্তব্য উপস্থাপন করে বলেন, ‘আমার দেশ সত্য ঘটনা তুলে ধরেছে মাত্র। রাষ্ট্র, বিচার বিভাগ ও জনস্বার্থে নির্ভুলভাবে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। আদালতের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়ে থাকলে সেটি ভুল তথ্য দিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসই করেছে। আদালত অবমাননার মামলা হলে তাদের বিরুদ্ধেই হওয়া উচিত ছিল।’ মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমি গর্ববোধ করি, আমার নেতৃত্বে আমার দেশ মানবাধিকার, আইনের শাসন ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে ভূমিকা পালন করছে। সত্যের জন্য লড়াই করতে হলে মূল্য দিতে হয়, আমি তা দিতে প্রস্তুত রয়েছি। হয়েছেও তাই। মাহমুদুর রহমান প্রথম দফায় দীর্ঘ ২৮৮ দিন কারাভোগের পর ২০১১ সালে ১৭ মার্চ গাজীপুর জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পান। ওই সময় মামলার হাজিরার নামে তাকে নেয়া হয়েছিল দেশের বিভিন্ন কারাগারে। মাহমুদুর রহমান সেসব ঘটনার বর্ণনা করে ‘জেল থেকে জেলে’ নামক একটি সাড়াজাগানো বই লিখেছেন। একজন সম্পাদকের লেখা রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষণধর্মী সেই বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ওই বইতে তিনি লিখেছেন কীভাবে সরকারের তাঁবেদার বাহিনী তাকে এক জেলখানা থেকে অন্য জেলখানায় নিয়ে হয়রানি ও নির্যাতন করেছে।
দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতার
২০১১ সালের ১৭ মার্চ কারামুক্তির পর দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব মানবাধিকারের পক্ষে সরকারের গণহত্যা, গণগ্রেফতার, গণনির্যাতনের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে কলাম লিখতে থাকেন মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। দৈনিক আমার দেশও অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী সংবাদ প্রকাশ করে পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়। পরিস্থিতি এমন হয় যে সর্বাধুনিক মেশিনে পত্রিকা ছাপিয়ে পাঠক চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সাহসী সংবাদ প্রকাশের ধারাবাহিকতায় কথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও তার প্রবাসী বন্ধু আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপে সংলাপ প্রকাশ করে। ওই সংবাদের সত্যতা স্বীকার করে পদত্যাগ করেন নিজামুল হক নাসিম। ধারাবাহিক ওই সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর আবারও চারদিক থেকে খাবলে ধরা হয় আমার দেশকে। স্কাইপে সংলাপ প্রকাশের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৩ এপ্রিল রাতে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর কর্তৃক সিএমএম আদালতে মামলা করা হয়। মামলা দায়েরের পর থেকে আমার দেশ কার্যালয়েই অবরুদ্ধ ছিলেন সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। কয়েক দফা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে চাইলেও আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেননি, বরং একটির পর একটি মামলা ও সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা টানা হুঙ্কার ছেড়েছেন মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে। শাহবাগের কথিত গণজাগরণ মঞ্চ থেকেও আমার দেশ সম্পাদককে গ্রেফতারের জন্য দফায় দফায় সারকারকে আল্টিমেটাম ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেয়া হয়। একটানা ৪ মাস আমার দেশ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ ও গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন মাহমদুর রহমান। পত্রিকা অফিসে আসা লোকজনকে তল্লাশি, ধরে নিয়ে যাওয়া, নজরদারিতে রাখাসহ নানাভাবে হয়রানি করা হয়।
স্কাইপে সংলাপ প্রকাশের জন্য আমার দেশ-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন সরকারপন্থী আইনজীবী আহজার উল্লাহ ভূঁইয়া। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিকের বেঞ্চ থেকে আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রুল জারি করা হয়। ওই রুল জারির কয়েক ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে এজাহার হিসেবে দায়ের করার নির্দেশ দেয়। ১৩ ডিসেম্বর মামলা দায়েরের পর থেকেই সারা দেশে খবর ছড়িয়ে পড়ে—যে কোনো সময় মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার হতে পারেন। মাহমুদুর রহমান নিজেও সংবাদসম্মেলন ডেকে নিজের গ্রেফতারের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেন। ১৪ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় তেজগাঁও থানায় মামলাটি আনুষ্ঠানিকভাবে রেকর্ড করেন। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলা করার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব-অনুমোদন নেয়ার শর্ত থাকলেও ওই মামলার ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি। মাহমুদুর রহমানকে অবরুদ্ধ রেখে তাকে গ্রেফতারের জন্য নানারকম ফন্দিফিকির করতে থাকে সরকার। ওই সময় সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপি আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে হঙ্কার দিতে থাকেন। টানা ১১৯ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর ১১ এপ্রিল সকাল ৮টায় হঠাত্ আমার দেশ কার্যালয়ে হানা দেয় শতাধিক সশস্ত্র ডিবি পুলিশ সদস্য। তারা উপস্থিত নিরাপত্তা কর্মী ও সাংবাদিকরা মারধর করে আমার দেশ সম্পাদককে তুলে নিয়ে যান। ওই দিন রাতেই তেজগাঁওয়ে আমার দেশ-এর প্রেস সিলগালা করে দেয় পুলিশ।
অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় আমার দেশ সম্পাদকের বিরুদ্ধে তেজগাঁও, শাহবাগ ও রমনা থানায় ৮টি মামলা দেয়া হয়। এর মধ্যে তেজগাঁও থানার দুটি মামলা দেয়া হয়েছে সশরীরে উপস্থিত থেকে বাস ও ট্যাক্সিক্যাবে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে। অপর ৬টি মামলা দেয়া হয়েছে সংবাদ লিখে শাহবাজের কথিত গণগাজরণ মঞ্চে হামলা চালানোর অভিযোগে। এসব মামলাতেও মাহমুদুর রহমানকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ১১ এপ্রিল গ্রেফতারের পর থেকে মাহমুদুর রহমান কারাবন্দি রয়েছেন।
মাহমুদুর রহমানের মা ও আবুল আসাদের বিরুদ্ধে মামলা
কোনো কারণ ছাড়াই প্রেস সিলগালা করার পর সরকার আমার দেশ বন্ধ করার পর বিকল্প ব্যবস্থায় দৈনিক আমার দেশ প্রকাশ করায় মগবাজারে দৈনিক সংগ্রামের আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস থেকে আমার দেশ-এর ১৯ সংবাদ কর্মীকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠায়। পত্রিকা ছাপানোর কারণে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মা মাহমুদা বেগম ও দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়াও ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বিনা কারণে দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক ও প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদকে আরেক দফায় গ্রেফতার করেছিল র্যাব। গ্রেফতারের পর তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়। পরে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশন বন্ধ
ব্লগে ইসলাম ও রাসুল (স.)-এর সম্পর্কে অবমাননাকর লেখার প্রতিবাদে এবং ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ও পরে ঢাকার শাপলা চত্বরে মহাবেশ করে। ওই সমাবেশে দুপুর থেকেই পুলিশ ও ক্ষমতাসীন জোটের ক্যাডাররা হামলা শুরু করে। চলতে থাকে সংঘর্ষ। এতে বিপুলসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রাণ হারান। দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন এসব হামলা সংঘর্ষের খবর সরাসরি প্রচার করতে থাকে। রাত আড়াইটায় বৈদ্যুতিক লাইন বন্ধ করে চারদিকে পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ যৌথবাহিনী ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’ নামে অভিযান শুরু করে। রাতের অন্ধকারে ঝিকিররত তৌহিদি জনতার ওপর চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি চালানো হয়। ওইসব গুলি, গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপের মাধ্যমে গণহত্যা ও লাশগুমের সরাসরি চিত্র বা কোনো ধরনের ভিডিও যাতে প্রচার করা সম্ভব না হয় সেজন্য অভিযানের সময় দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হয়। হঠাত্ বন্ধ করে দেয়া চ্যানেল দুটি এখন পর্যন্ত খুলে দেয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় তথ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন মহলে ধরনা দিয়েও কোনো ফল হয়নি। চ্যানেল দুটির সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীরা বেকার অবস্থায় রয়েছেন। বন্ধ করার আগেও দিগন্ত টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। স্যাটেলাইট ভাড়া দেয়ার জন্য টাকা পাঠানোর অনুমতি না দেয়া, সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান কভার করতে না দেয়া, নানাভাবে হুমকি-ধমকির মধ্যেই কেটেছে চ্যানেলটির পুরো সময়কাল।
চ্যানেল ওয়ান বন্ধ
২০১০ সালের ১৭ এপ্রিল বন্ধ করে দেয়া হয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ওয়ান। সরকারের দাবি ছিল অনিয়মের কারণে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। মূলত চ্যানেল ওয়ানের মালিক প্রফেসর মাজেদুল ইসলাম জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় তার চ্যানেল বন্ধ করে শত শত সাংবাদিককে বেকার করে দেয়া হয়েছে।
একুশে টেলিভিশনকে হয়রানি
কিছুটা নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার করায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষ বিটিআরসি ও এনবিআরের মাধ্যমে একুশে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে দফায় দফায় হয়রানি করা হয়। তাদের তরঙ্গ স্থগিত রাখা, স্যাটেলাইট ভাড়া দেয়ার সুযোগ না দেয়াসহ নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়।
যমুনা টেলিভিশনকে আসতে দেয়া হয়নি
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সম্প্রচারের অনুমতি পায় যমুনা টেলিভিশন। মোটা অঙ্কের বাজেট নিয়ে ২০০৯ সালের ১৫ অক্টোবর চ্যানেলটি পরীক্ষামূলক সম্প্রচার শুরু করে। পরীক্ষামূলক সম্প্রচার শুরুর পর যমুনা কর্তৃপক্ষ যখন পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখনই চ্যানেলটির বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চালুর ৩৪ দিন পর যমুনা টেলিভিশন সরকারের নির্দেশে পরীক্ষামূলক সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় বিটিআরসি। জব্দ করা হয় যন্ত্রপাতি। সম্প্রচার কক্ষ সিলগালা করে দেয়া হয় ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর। এর পর থেকে যমুনার সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্ট থেকে সম্প্রচারের অনুমতি পেয়েছে চ্যানেলটি।
শীর্ষ নিউজ বন্ধ ও সম্পাদককে গ্রেফতার
শীর্ষ নিজউ ডটকম নামে একটি অনলাইন পত্রিকা ২০০৯ সালের ১৭ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে অল্প দিনেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ২০১১ সালে রোষানলে পড়ে অনলাইন শীর্ষ নিউজ ডটকম ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ। শীর্ষ নিউজ ডটকম ও শীর্ষ কাগজের ১০ সাংবাদিকের সব অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করে সরকার। ২০১১ সালের ৩১ আগস্ট শীর্ষ কাগজ ও শীর্ষ নিউজ সম্পাদক ইকরামুল হককে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সাজানো মামলা দিয়ে চার দিনের রিমান্ডে এবং রিমান্ড শেষে জেলহাজতে পাঠানো হয়। অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যায় জনপ্রিয় অনলাইন শীর্ষ নিউজ ডটকম ও সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজ। দীর্ঘ কারাভোগ শেষে শীর্ষকাগজ সম্পাদক ওই বছর ২৫ নভেম্বর মুক্তি পান। ২০১৩ সালে সীমিত পরিসরে শীর্ষ নিউজ ডটকম নতুন করে যাত্রা শুরু করে।
অন্যান্য
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সরাসরি হুমকির শিকার হয়েছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবীর ও আমাদের সময় সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানসহ আরও বেশ কয়েকজন সম্পাদক। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদও পড়েছেন সরকারের রোষানলে। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সিরিজ মামলা করা হয়েছে। এমপি রনির সরাসরি হামলার শিকার হয়েছে ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের দুই সাংবাদিক। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সরকারবিরোধী ব্যক্তিদের পরিচালিত কমপক্ষে এক ডজনের বেশি অনলাইন। এছাড়াও রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের শত শত সাংবাদিক হামলা ও মামলার শিকার হয়েছেন। এর যেন শেষ নেই। মূলত সরকারের দুর্নীতি অপকর্ম ধামাচাপা দিতেই দেশজুড়ে মিডিয়ার টুঁটি চেপে ধরে সরকার।
আওয়ামী লীগের সাংবাদিক নির্যাতন নতুন কিছু নয়। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বাকশাল কায়েমের সময় ১৬ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারের লিফলেট আকারে চারটি সংবাদপত্র রেখে সব জাতীয়, আঞ্চলিক দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। বেকার হয়েছিলেন হাজার হাজার সাংবাদিক। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ১০ সাংবাদিক খুন হন এবং বহু সাংবাদিক হামলা ও নির্যাতনের শিকার হন। ওই সময় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল ট্রাস্ট পরিচালিত পত্রিকা দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস, বিচিত্রা, আনন্দা বিচিত্রাসহ বহু কাগজ। এবারও ক্ষমতায় এসে একই ধরনের নজির স্থাপন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার।
১৯ সাংবাদিক খুন
মহাজোট সরকারের শাসনামলে খুন হয়েছেন ১৯ সাংবাদিক। নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে শুধু সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ দম্পতির নামমাত্র বিচার হয়েছে। বহুল
আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডসহ ১৮টি হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। প্রকৃত আসামিরাও গ্রেফতার হয়নি।
২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক মূলস্রোত পত্রিকার সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদেরই দায়ী করেছেন নিহতের পরিবারের লোকজন। এর আগে ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পত্রিকার কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হয়েছেন সাপ্তাহিক অপরাধ দমন পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক দুর্জয় চৌধুরী দীপু। ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর নরসিংদীতে খুন হন দৈনিক নরসিংদীর বাণী পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার তালহাদ আহমেদ কাবিদ। গত ১১ ফেব্রুয়ারি নিজ ফ্ল্যাটে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি। বহুল আলোচিত সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও মামলার আসামিদের গ্রেফতারে এখনও কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। সারা দেশের মানুষ এখনও উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য জানতে চাইছে। কিন্তু তদন্ত সংস্থা পুলিশ, র্যাব, সিআইডি বরাবরই এ বিষয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
২০১১ সালের ১৬ জুন সারা দেশের সাংবাদিক সমাজ যখন সংবাদপত্রের কালো দিবস পালন করছিল, ঠিক ওই সময়ে যশোরের শার্শা উপজেলায় দৈনিক গ্রামের কাগজের শার্শা প্রতিনিধি জামাল উদ্দিন খুন হন। সরকারি দল আশ্রিত মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সংবাদ লেখায় পুলিশের সহযোগিতায় খুন করা হয় জামাল উদ্দিনকে। তার হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। ২০১১ সালের ১০ জুলাই খুন হয়েছেন হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে দৈনিক বিবিয়ানার স্টাফ রিপোর্টার জুনায়েদ আহমদ জুনেদ। তাকে নৃশংসভাবে খুনের পর লাশ রেললাইনে ফেলে রাখা হয়েছিল। একই বছরের ২৮ জানুয়ারি নয়াপল্টনের বাসায় খুন হওয়া প্রবীণ সাংবাদিক ও দৈনিক জনতার সহসম্পাদক ফরহাদ খাঁ (৬০) ও তার স্ত্রী রহিমা খাঁ (৫৫)। ২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কুকরাইল এলাকায় গলাকেটে হত্যা করা হয় দৈনিক ভোরের ডাকের গোবিন্দগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জুকে। একই বছর ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনি এলাকায় দৈনিক আজকের প্রত্যাশা, সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র ও আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার সাংবাদিক মাহবুব টুটুলকে খুন করা হয়। একই দিন অর্থাত্ ২০১০ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকার উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠের সাংবাদিক আলতাফ হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ২০১০ সালের ৯ মে গুপ্তহত্যার শিকার হন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার সিনিয়র ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম টুটুল। যদিও পুলিশের দাবি টুটুল সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয়েছে। তার হত্যার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হামলার পর ২৮ এপ্রিল নিহত হন সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি সাহসী সাংবাদিক ফতেহ ওসমানী। সরকারি দল-আশ্রিত হওয়ায় ফতেহ ওসমানীর খুনিরা গ্রেফতার হয়নি। ২০০৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন বরিশালের মুলাদী প্রেস ক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক, একই বছর জুলাই মাসে ঢাকার পাক্ষিক মুক্তমনের স্টাফ রিপোর্টার নুরুল ইসলাম ওরফে রানা, আগস্ট মাসে গাজীপুরে ঢাকার সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময়-এর নির্বাহী সম্পাদক এমএম আহসান হাবিব বারী, ডিসেম্বরে রূপগঞ্জে দৈনিক ইনকিলাব সংবাদদাতা ও রূপগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি আবুল হাসান আসিফ খুন হন। যদিও পুলিশ দাবি করেছে আবুল হাসান আসিফ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।
আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমান প্রসঙ্গ
মহাজোট সরকারের আমলে যে মিডিয়াটির সবচেয়ে বেশি টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে যে মিডিয়াটি সর্বাধিক হামলা, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে সেটি হচ্ছে দৈনিক আমার দেশ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নিরপেক্ষ ও সাহসী সংবাদ প্রকাশের কারণে আমার দেশ সরকারের রোষানলে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ইলাহীর বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের খবর পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর থেকে সারা দেশে হামলা চলতে থাকে আমার দেশ-এর ওপর, হতে থাকে সিরিজ মামলা। দুর্নীতি রিপোর্ট করায় সাংবাদিক এম আবদুল্লাহর ওপর রাজধানীর বনানীতে হামলা চালানো হয়। এতে গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ওই রিপোর্টের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৫টি মামলা দেয় সরকারি দল। ২০১০ সালের ১ জুন শত শত সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীর বিক্ষোভ বাধা উপেক্ষা করে সাংবাদিকদের মারধর করে আমার দেশ কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ায় হয় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। তাকে গ্রেফতারের সময় শত শত পুলিশ ঘিরে ফেলে আমার দেশ কার্যালয়। বন্ধ করে দেয়া হয় খাবার পানি সরবরাহ ডিসলাইনসহ সবকিছু। পরদিনই সরকার আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করায় পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা ওই দিনই রাত ১১টায় সিলগালা করে দেয়। ১০ জুন ২০১০ বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চ পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশের পরও সরকার পত্রিকার ছাপাখানা খুলে দেয়নি। এরপর ১৫ জুন, ২০১০ আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগের স্থগিতাদেশ অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা) চার সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন। বন্ধ করার সময় আমার দেশ পত্রিকায় সাত শতাধিক সাংবাদিক ও স্টাফ কর্মরত ছিল।
প্রথম দফায় গ্রেফতারের পর ২ জুন ভোররাত ৪টায় পুলিশ আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় হাসমত আলীর দায়ের করা কথিত মামলায় আমার দেশ পত্রিকা অফিস থেকে গ্রেফতার করে। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের সময় পুলিশকে মারধর ও সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে শতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। মামলায় মাহমুদুর রহমান ছাড়াও আমার দেশ-এর নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, বার্তা সম্পাদক জাহেদ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরী ও সিনিয়র রিপোর্টার আলাউদ্দিন আরিফসহ ৫ জনকে এজহারভুক্ত আসামি করে। পরে এই মামলায় আমার দেশ-এর সব সাংবাদিকের রিমান্ডে নেয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। আমার দেশ সম্পাদককে গ্রেফতারের আগে ২০১০ সালের গত ১ জুন সকাল ৯টায় পত্রিকাটির প্রকাশক মো. হাসমত আলীকে তার শাহজাহানপুরের বাসা থেকে এনএসআই সদস্যরা আটক করে তাদের অফিসে নিয়ে কয়েকটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। পরে জানা যায়, ওই কাগজপত্রে লেখা হয়েছে, তিনি কিছুদিন আগে মাহমুদুর রহমানের কাছে পত্রিকার শেয়ার হস্তান্তর করেছেন। তারপরও মাহমুদুর রহমান প্রকাশক হিসেবে তার নাম ছেপে আসছেন। এ কারণে পত্রিকাটিতে কিছু রিপোর্ট ছাপার অভিযোগে মাহমুদুর রহমানের পাশাপাশি তার বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হচ্ছে। মাহমুদুর রহমান আমার দেশের প্রকাশক হিসেবে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে ২০০৯ সালে একটি আবেদন করেছিলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসন সরকারি নির্দেশে সেই আবেদনটি দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখে পরে বাতিল করে দেয়। পরে হাশমত আলী নিজেই ওই মামলা প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু পুলিশ এর পরও ওই মামলায় আদালতে চার্জশিট দিয়েছে।
প্রথম দফায় অফিস থেকে গ্রেফতারের পর মাহমুদুর রহমানকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করার পর আদালত হাসমত আলীর স্বাক্ষর করা মামলায় তার জামিন মঞ্জুর করেন। তবে পুলিশকে মারধর ও সরকারি কাজে বাধাদানের মামলায় জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন। পুলিশ আদালতের কাছে ৫ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত প্রয়োজনে তিন দিনের মধ্যে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। ২ জুন, ২০১০ মাহমুদুর রহমানকে আদালতে হাজির করার সময় উপস্থিত লোকজন বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। ওই দিনই পুলিশকে মারধর করার জন্য কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয় এবং সেই মামলায় মাহমুদুর রহমানকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে ৭ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে তেজগাঁও থানার মামলায় ৩ দিন এবং কোতোয়ালি থানার মামলায় এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ২০১০ সালের ৬ জুন উত্তরা থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে পুরনো মামলায় মাহমুদুর রহমানকে যুক্ত করা হয় এবং ৭ জুন ২০১০ বিমানবন্দর থানায় তার বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়েই কথিত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে। উত্তরা থানা এবং বিমানবন্দর থানা পুলিশ মামলার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মোট ২০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত ৪ দিন করে আরো ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এর ফলে মাহমুদুর রহমানকে প্রথম দফায় মোট ১২ দিনের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। ২০১০ সালের ৮ জুন মাহমুদুর রহমানকে আদালতে হাজির করা হলে তিনি আদালতে বলেন, ‘আমাকে নির্যাতন করা হয়েছে। আমি খেতে চেয়েছি। কিন্তু খাওয়া-দাওয়া তো দূরে থাক পুলিশ আমাকে এক ফোঁটা পানিও দেয়নি। এ সরকার আমাকে মেরে ফেলবে। আমি আর হয়তো জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারব না।’ ৮ জুন ২০১০-এ কোতোয়ালি থানার রিমান্ড শেষে ৯ জুন মাহমুদুর রহমানকে আদালতে হাজির করা হয় এবং তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ৩ দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়। কিন্তু তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার রিমান্ডে নেয়া হলেও তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্ট থানা হাজতে। ১২ জুন, ২০১০ মাহমুদুর রহমানকে তেজগাঁও থানার মামলায় (২(৬)২০১০) ৩ দিনের রিমান্ড শেষে ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন বাহার রুমীর আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্ট থানা থেকে ১০ জুন ভোররাত পৌনে ২টায় ৫ জন লোক এসে আমার চোখ বেঁধে বিবস্ত্র করে ফেলে এবং অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে কনুই দিয়ে বুকে ও পিঠে জোরে আঘাত করলে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরে এলে দেখি ক্যান্টনমেন্ট থানার সেকেন্ড অফিসারের রুমে শুয়ে আছি।’
পরে উত্তরা থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার দেখানোর মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা ৯ জুন মঞ্জুর করা চার দিনের জন্য রিমান্ডে নেয়ার আবেদন পেশ করলে ম্যাজিস্ট্রেট রাশেদ কবীর কোর্ট হাজতখানা থেকে মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে নেয়ার আদেশ দেন।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ডিবি অফিসে নেয়া হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত ১৬ জুন, ২০১০ তাকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠায় এবং সুচিকিত্সার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়। কারাগারে মাহমুদুর রহমান চরম অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০ জুন, ২০১০ কারাগারে চিকিত্সাধীন মাহমুদুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তখনও তার শরীরে ছিল ব্যাপক নির্যাতনের চিহ্ন। ২০১০ সালের ২৩ জুন সকালে নম্বরপ্লেটবিহীন দুটি গাড়িতে করে ডিবি অফিস থেকে বের করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৪ জুন মাহমুদুর রহমানকে সিএমএম কোর্টে হাজির করা হলে তিনি আদালতে বলেন, তাকে র্যাব-১ কার্যালয়ে নিয়ে সকাল আনুমানিক ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চোখ বেঁধে কবরের মতো একটি ছোট সেলে হাতকড়া পড়িয়ে গ্রিলের সঙ্গে আটকিয়ে রাখা হয়।’ তিনি আদালতকে প্রশ্ন করে বলেন, ‘নির্যাতনের সংজ্ঞা কী?’ এ ছাড়া মাহমুদুর রহমান তার আইনজীবীর কাছে জানান, র্যাব-১ কার্যালয়ে নেয়ার পর তার কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর এবং আঙুলের ছাপ নেয়া হয়। এরপর আদালত মাহমুদুর রহমানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এছাড়া মাহমুদুর রহমানকে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই দুদকের দায়ের করা একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পরে এসব মামলায় তিনি আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।
২০১০ সালের ১৯ আগস্ট সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন নজির সৃষ্টি করে আদালত অবমাননার অভিযোগে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ৬ মাসের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ড দেয়। এছাড়াও প্রতিবেদক অলিউল্লাহ নোমানকে এক মাসের কারাদণ্ড, দশ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৭ দিনের কারাদণ্ড এবং প্রকাশক মো. হাশমত আলীকে দশ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ৭ দিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়। ওই বছরের ২১ এপ্রিল আমার দেশ পত্রিকায় ‘চেম্বার জজ মানেই সরকার পক্ষের স্টে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্যে সুপ্রিমকোর্টের সরকারপন্থী দুই আইনজীবীর করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ ওই দণ্ড দেয়। মামলার শুনানিতে ‘আমার দেশ’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান নিজেই বক্তব্য উপস্থাপন করে বলেন, ‘আমার দেশ সত্য ঘটনা তুলে ধরেছে মাত্র। রাষ্ট্র, বিচার বিভাগ ও জনস্বার্থে নির্ভুলভাবে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। আদালতের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়ে থাকলে সেটি ভুল তথ্য দিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসই করেছে। আদালত অবমাননার মামলা হলে তাদের বিরুদ্ধেই হওয়া উচিত ছিল।’ মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমি গর্ববোধ করি, আমার নেতৃত্বে আমার দেশ মানবাধিকার, আইনের শাসন ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে ভূমিকা পালন করছে। সত্যের জন্য লড়াই করতে হলে মূল্য দিতে হয়, আমি তা দিতে প্রস্তুত রয়েছি। হয়েছেও তাই। মাহমুদুর রহমান প্রথম দফায় দীর্ঘ ২৮৮ দিন কারাভোগের পর ২০১১ সালে ১৭ মার্চ গাজীপুর জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পান। ওই সময় মামলার হাজিরার নামে তাকে নেয়া হয়েছিল দেশের বিভিন্ন কারাগারে। মাহমুদুর রহমান সেসব ঘটনার বর্ণনা করে ‘জেল থেকে জেলে’ নামক একটি সাড়াজাগানো বই লিখেছেন। একজন সম্পাদকের লেখা রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষণধর্মী সেই বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ওই বইতে তিনি লিখেছেন কীভাবে সরকারের তাঁবেদার বাহিনী তাকে এক জেলখানা থেকে অন্য জেলখানায় নিয়ে হয়রানি ও নির্যাতন করেছে।
দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতার
২০১১ সালের ১৭ মার্চ কারামুক্তির পর দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব মানবাধিকারের পক্ষে সরকারের গণহত্যা, গণগ্রেফতার, গণনির্যাতনের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে কলাম লিখতে থাকেন মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। দৈনিক আমার দেশও অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী সংবাদ প্রকাশ করে পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়। পরিস্থিতি এমন হয় যে সর্বাধুনিক মেশিনে পত্রিকা ছাপিয়ে পাঠক চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সাহসী সংবাদ প্রকাশের ধারাবাহিকতায় কথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও তার প্রবাসী বন্ধু আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপে সংলাপ প্রকাশ করে। ওই সংবাদের সত্যতা স্বীকার করে পদত্যাগ করেন নিজামুল হক নাসিম। ধারাবাহিক ওই সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর আবারও চারদিক থেকে খাবলে ধরা হয় আমার দেশকে। স্কাইপে সংলাপ প্রকাশের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৩ এপ্রিল রাতে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর কর্তৃক সিএমএম আদালতে মামলা করা হয়। মামলা দায়েরের পর থেকে আমার দেশ কার্যালয়েই অবরুদ্ধ ছিলেন সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। কয়েক দফা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে চাইলেও আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেননি, বরং একটির পর একটি মামলা ও সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা টানা হুঙ্কার ছেড়েছেন মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে। শাহবাগের কথিত গণজাগরণ মঞ্চ থেকেও আমার দেশ সম্পাদককে গ্রেফতারের জন্য দফায় দফায় সারকারকে আল্টিমেটাম ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেয়া হয়। একটানা ৪ মাস আমার দেশ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ ও গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন মাহমদুর রহমান। পত্রিকা অফিসে আসা লোকজনকে তল্লাশি, ধরে নিয়ে যাওয়া, নজরদারিতে রাখাসহ নানাভাবে হয়রানি করা হয়।
স্কাইপে সংলাপ প্রকাশের জন্য আমার দেশ-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন সরকারপন্থী আইনজীবী আহজার উল্লাহ ভূঁইয়া। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিকের বেঞ্চ থেকে আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রুল জারি করা হয়। ওই রুল জারির কয়েক ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে এজাহার হিসেবে দায়ের করার নির্দেশ দেয়। ১৩ ডিসেম্বর মামলা দায়েরের পর থেকেই সারা দেশে খবর ছড়িয়ে পড়ে—যে কোনো সময় মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার হতে পারেন। মাহমুদুর রহমান নিজেও সংবাদসম্মেলন ডেকে নিজের গ্রেফতারের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেন। ১৪ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় তেজগাঁও থানায় মামলাটি আনুষ্ঠানিকভাবে রেকর্ড করেন। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলা করার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব-অনুমোদন নেয়ার শর্ত থাকলেও ওই মামলার ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি। মাহমুদুর রহমানকে অবরুদ্ধ রেখে তাকে গ্রেফতারের জন্য নানারকম ফন্দিফিকির করতে থাকে সরকার। ওই সময় সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপি আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে হঙ্কার দিতে থাকেন। টানা ১১৯ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর ১১ এপ্রিল সকাল ৮টায় হঠাত্ আমার দেশ কার্যালয়ে হানা দেয় শতাধিক সশস্ত্র ডিবি পুলিশ সদস্য। তারা উপস্থিত নিরাপত্তা কর্মী ও সাংবাদিকরা মারধর করে আমার দেশ সম্পাদককে তুলে নিয়ে যান। ওই দিন রাতেই তেজগাঁওয়ে আমার দেশ-এর প্রেস সিলগালা করে দেয় পুলিশ।
অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় আমার দেশ সম্পাদকের বিরুদ্ধে তেজগাঁও, শাহবাগ ও রমনা থানায় ৮টি মামলা দেয়া হয়। এর মধ্যে তেজগাঁও থানার দুটি মামলা দেয়া হয়েছে সশরীরে উপস্থিত থেকে বাস ও ট্যাক্সিক্যাবে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে। অপর ৬টি মামলা দেয়া হয়েছে সংবাদ লিখে শাহবাজের কথিত গণগাজরণ মঞ্চে হামলা চালানোর অভিযোগে। এসব মামলাতেও মাহমুদুর রহমানকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ১১ এপ্রিল গ্রেফতারের পর থেকে মাহমুদুর রহমান কারাবন্দি রয়েছেন।
মাহমুদুর রহমানের মা ও আবুল আসাদের বিরুদ্ধে মামলা
কোনো কারণ ছাড়াই প্রেস সিলগালা করার পর সরকার আমার দেশ বন্ধ করার পর বিকল্প ব্যবস্থায় দৈনিক আমার দেশ প্রকাশ করায় মগবাজারে দৈনিক সংগ্রামের আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস থেকে আমার দেশ-এর ১৯ সংবাদ কর্মীকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠায়। পত্রিকা ছাপানোর কারণে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মা মাহমুদা বেগম ও দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়াও ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বিনা কারণে দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক ও প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদকে আরেক দফায় গ্রেফতার করেছিল র্যাব। গ্রেফতারের পর তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়। পরে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশন বন্ধ
ব্লগে ইসলাম ও রাসুল (স.)-এর সম্পর্কে অবমাননাকর লেখার প্রতিবাদে এবং ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ও পরে ঢাকার শাপলা চত্বরে মহাবেশ করে। ওই সমাবেশে দুপুর থেকেই পুলিশ ও ক্ষমতাসীন জোটের ক্যাডাররা হামলা শুরু করে। চলতে থাকে সংঘর্ষ। এতে বিপুলসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রাণ হারান। দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন এসব হামলা সংঘর্ষের খবর সরাসরি প্রচার করতে থাকে। রাত আড়াইটায় বৈদ্যুতিক লাইন বন্ধ করে চারদিকে পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ যৌথবাহিনী ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’ নামে অভিযান শুরু করে। রাতের অন্ধকারে ঝিকিররত তৌহিদি জনতার ওপর চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি চালানো হয়। ওইসব গুলি, গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপের মাধ্যমে গণহত্যা ও লাশগুমের সরাসরি চিত্র বা কোনো ধরনের ভিডিও যাতে প্রচার করা সম্ভব না হয় সেজন্য অভিযানের সময় দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হয়। হঠাত্ বন্ধ করে দেয়া চ্যানেল দুটি এখন পর্যন্ত খুলে দেয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় তথ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন মহলে ধরনা দিয়েও কোনো ফল হয়নি। চ্যানেল দুটির সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীরা বেকার অবস্থায় রয়েছেন। বন্ধ করার আগেও দিগন্ত টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। স্যাটেলাইট ভাড়া দেয়ার জন্য টাকা পাঠানোর অনুমতি না দেয়া, সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান কভার করতে না দেয়া, নানাভাবে হুমকি-ধমকির মধ্যেই কেটেছে চ্যানেলটির পুরো সময়কাল।
চ্যানেল ওয়ান বন্ধ
২০১০ সালের ১৭ এপ্রিল বন্ধ করে দেয়া হয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ওয়ান। সরকারের দাবি ছিল অনিয়মের কারণে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। মূলত চ্যানেল ওয়ানের মালিক প্রফেসর মাজেদুল ইসলাম জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় তার চ্যানেল বন্ধ করে শত শত সাংবাদিককে বেকার করে দেয়া হয়েছে।
একুশে টেলিভিশনকে হয়রানি
কিছুটা নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার করায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষ বিটিআরসি ও এনবিআরের মাধ্যমে একুশে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে দফায় দফায় হয়রানি করা হয়। তাদের তরঙ্গ স্থগিত রাখা, স্যাটেলাইট ভাড়া দেয়ার সুযোগ না দেয়াসহ নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়।
যমুনা টেলিভিশনকে আসতে দেয়া হয়নি
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সম্প্রচারের অনুমতি পায় যমুনা টেলিভিশন। মোটা অঙ্কের বাজেট নিয়ে ২০০৯ সালের ১৫ অক্টোবর চ্যানেলটি পরীক্ষামূলক সম্প্রচার শুরু করে। পরীক্ষামূলক সম্প্রচার শুরুর পর যমুনা কর্তৃপক্ষ যখন পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখনই চ্যানেলটির বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চালুর ৩৪ দিন পর যমুনা টেলিভিশন সরকারের নির্দেশে পরীক্ষামূলক সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় বিটিআরসি। জব্দ করা হয় যন্ত্রপাতি। সম্প্রচার কক্ষ সিলগালা করে দেয়া হয় ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর। এর পর থেকে যমুনার সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্ট থেকে সম্প্রচারের অনুমতি পেয়েছে চ্যানেলটি।
শীর্ষ নিউজ বন্ধ ও সম্পাদককে গ্রেফতার
শীর্ষ নিজউ ডটকম নামে একটি অনলাইন পত্রিকা ২০০৯ সালের ১৭ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে অল্প দিনেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ২০১১ সালে রোষানলে পড়ে অনলাইন শীর্ষ নিউজ ডটকম ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ। শীর্ষ নিউজ ডটকম ও শীর্ষ কাগজের ১০ সাংবাদিকের সব অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করে সরকার। ২০১১ সালের ৩১ আগস্ট শীর্ষ কাগজ ও শীর্ষ নিউজ সম্পাদক ইকরামুল হককে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সাজানো মামলা দিয়ে চার দিনের রিমান্ডে এবং রিমান্ড শেষে জেলহাজতে পাঠানো হয়। অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যায় জনপ্রিয় অনলাইন শীর্ষ নিউজ ডটকম ও সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজ। দীর্ঘ কারাভোগ শেষে শীর্ষকাগজ সম্পাদক ওই বছর ২৫ নভেম্বর মুক্তি পান। ২০১৩ সালে সীমিত পরিসরে শীর্ষ নিউজ ডটকম নতুন করে যাত্রা শুরু করে।
অন্যান্য
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সরাসরি হুমকির শিকার হয়েছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবীর ও আমাদের সময় সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানসহ আরও বেশ কয়েকজন সম্পাদক। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদও পড়েছেন সরকারের রোষানলে। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সিরিজ মামলা করা হয়েছে। এমপি রনির সরাসরি হামলার শিকার হয়েছে ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের দুই সাংবাদিক। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সরকারবিরোধী ব্যক্তিদের পরিচালিত কমপক্ষে এক ডজনের বেশি অনলাইন। এছাড়াও রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের শত শত সাংবাদিক হামলা ও মামলার শিকার হয়েছেন। এর যেন শেষ নেই। মূলত সরকারের দুর্নীতি অপকর্ম ধামাচাপা দিতেই দেশজুড়ে মিডিয়ার টুঁটি চেপে ধরে সরকার।
No comments:
Post a Comment