Monday 27 January 2014

বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরা : মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিস্ময়কর নীরবতা : ‘বন্দুকযুদ্ধে’র গল্পে নিরাপত্তা বাহিনী ও গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে

আওয়ামী লীগবিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। একতরফা নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার শপথ নেয়ার পর গত কয়েকদিনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে হত্যা মিশন আরো জোরদার হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পর গত দু’দিনে বিএনপি-জামায়াতের অন্তত ৫ নেতা নিহত হয়েছেন।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের প্রায় প্রতিদিনই গ্রেফতারের পর বন্দুকযুদ্ধের গল্প বলে নির্বিচারে হত্যা করলেও দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিস্ময়কর নীরবতা পালন করছে। প্রতিদিন স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী এবং নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদের হত্যা করা হলেও দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কর্তাব্যক্তিরা এ নিয়ে টুঁশব্দটিও করছেন না। 
একই অবস্থা দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমেরও। আওয়ামীপন্থী এসব গণমাধ্যম ‘বন্দুকযুদ্ধে’র গল্প প্রকাশ করেই কার্যত এসব হত্যাযজ্ঞকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করছে। এতে নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি এসব গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাও তলানিতে ঠেকেছে। তবে দেশে সরকারবিরোধী কোনো শক্তিশালী গণমাধ্যম না থাকায় জনগণকে তথ্যের জন্য এসব আওয়ামীপন্থী গণমাধ্যমের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। কয়েকদিন আগেও পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন রকমের।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় গণপ্রতিরোধ চলছিল, তখন এসব সংগঠনের শোরগোল ছিল চোখের পড়ার মতো। ‘রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’-এর মতো ভুঁইফোড় সংগঠনও তখন আকাশ বাতাস ভারী করে ফেলেছিল। এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
তখন কোনো বাড়িঘরে আগুন লাগলে, কেউ আহত হলে সেসব ছবি আওয়ামীপন্থী গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো নারীর কান্নার ছবি থাকলে তা বারবার প্রচার করা হয়েছে।
অথচ এখন ঠিক তার বিপরীত অবস্থা। প্রায় প্রতিদিনই দু-চারজন করে বিরোধী নেতাকর্মীকে হত্যা করা হলেও সেসব খবর এখন ডাউনপ্লে হচ্ছে। স্বজন হারানোদের কান্নার ছবি এখন আর চোখে পড়ে না।
দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি এসব হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানিয়ে একে ‘আলবদর বাহিনীর বর্বরতা’র সঙ্গে তুলনা করেছে। দেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীও এসব হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানিয়েছে।
তবে তারা দলীয় নেতাকর্মীদের রক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
গত ২২ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সরকার সরাসরি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছে। সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকবলিত। এসব জায়গা দেখে মনে পড়ে পাক হানাদারদের নৃশংসতার ঘটনা।’
তিনি বলেন, ‘দলীয় হিসাবে গত তিন মাসে সারাদেশে ২২৭ জন নিহত ও গুম হয়েছে ১৮৭ জন। আর জোটগত হিসাবে ১৮ দলসহ নিহতের এ সংখ্যা ২৯৪ জন।’
সংবাদ সম্মেলনে গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিরোধী জোটের নিহত ও গুমের তালিকা সরবরাহ করা হয়। এতে দেখা যায়, যৌথবাহিনীর অভিযানে চট্টগ্রাম বিভাগে ১০১, সিলেটে ৩, রাজশাহীতে ৪০, রংপুরে ১৫, খুলনায় ৫০, ঢাকায় ১৩ ও বরিশাল বিভাগে ৫ জন মিলে বিএনপির ২২৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর সঙ্গে জামায়াতসহ জোটভুক্ত অন্যান্য দলের আরও ৬৭ জন মিলে যৌথবাহিনীর অভিযানে ১৮ দলীয় জোটের মোট নিহতের সংখ্যা ২৯৪ জন।
গ্রেফতারের পর গতকাল সোমবারও সাতক্ষীরায় এক ছাত্রদল নেতা ও পাবনায় যুবদলের এক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগের দিন, রোববারও জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের ৩ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।
গত রোববার এক বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ বলেন, গত ৪৩ দিনে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের ৫৯ নেতাকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সরকার অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় জামায়াত ও ছাত্রশিবির নেতাদের একে একে গুলি করে হত্যা করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
১০ দিনে গ্রেফতার ২২ হাজার
এদিকে গত ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগের রাত থেকে দেশজুড়ে সহিংসতায় ৩১৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নামে-বেনামে আসামি করা হয়েছে ৬৩ হাজারের বেশি লোককে।
পুলিশ সদর দফতরের হিসাবে, নির্বাচনের পর ১৭ জানুয়ারি থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ১০ দিনেই গ্রেফতার হয়েছে ২২ হাজার ৪৮৯ জন। তবে এসব আসামির মধ্যে পুলিশের নিয়মিত গ্রেফতারের আসামিও রয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
২৫ জেলায় মোট ৩১৫টি মামলার মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে যশোরে, ৬৩টি। গাইবান্ধায় ৫৩, দিনাজপুরে ৪৬, লক্ষ্মীপুরে ৩১ ও ঠাকুরগাঁওয়ে ২০টি মামলা হয়েছে। বেশিরভাগ মামলায় আসামি ‘অজ্ঞাত’ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।
এদিকে, বিভিন্ন স্থানে গ্রেফতারের পর বিরোধী নেতাকর্মীদের হত্যা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতরাতে বিবিসি-কে বলেন, ‘এগুলো ক্রসফায়ার নয়। অপারেশনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর আক্রমণ চালালে তারাও আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা আক্রমণ চালায়। তখনই এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে।’
সরকারবিরোধীদের ধরে নিয়ে হত্যা করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ধরে নিয়ে হত্যা করার অভিযোগ সঠিক নয়।
উল্লেখ্য, নির্বাচনকেন্দ্রিক অস্থিরতার পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে সহিংসতায় ২০১৩ সালে ৫০৭ জন মারা যায় বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। এ সময় আহত হয়েছেন ২২ হাজার ৪০৭ জন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২০১৩ সালটি ছিল সবচেয়ে রাজনৈতিক সহিংসতাপূর্ণ।
তবে ২০১৪ সালটি শুরু হয়েছে আরো ভয়ঙ্করভাবে। গত ২৭ দিনে রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ৬২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের ৪৫ জন নেতাকর্মী নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতেই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন অথবা গ্রেফতারের পর লাশ পাওয়া গেছে।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2014/01/28/233850#.UubF0b3frIU

No comments:

Post a Comment