Friday, 27 September 2013

হায়দ্রাবাদ, মুসলিম গণহত্যার এক অজানা কাহিনী


হায়দ্রাবাদ: ব্রিটিশ থেকে ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় ১৯৪৭ সালে হিন্দু ও মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রায় ৫ লাখ লোক নিহত হয়। প্রধানত ভারত-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতেই ওই হতাহতের ঘটনা ঘটে। খবর: বিবিসি’র।

কিন্তু এর এক বছর পরই মধ্য ভারতে আরেকটি নির্মম গণহত্যার ঘটনা ঘটে। ওই গণহত্যার ঘটনা আজও ইতিহাসে অস্পষ্ট রয়ে গেছে।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে মুক্ত হওয়ার পর ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে মধ্য ভারতে প্রায় আধা লাখ মুসলিমকে হত্যা করে নতুন ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ। তাদের লাইন ধরিয়ে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

ওই ঘটনার ব্যাপারে ভারত সরকার কখনোই কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ফলে খুব অল্পসংখ্যক ভারতীয়ই ওই গণহত্যার কথা জানে। সমালোচকরা দাবি করেন, ভারতের প্রতিটি সরকারই ওই ঘটনার তথ্য গোপন করে রেখেছে।

ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় যে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় তার এক বছর পর মধ্যভারতের হায়দ্রাবাদে ওই গণহত্যার ঘটনা ঘটে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারত প্রায় ৫০০টি স্বায়ত্ত শাসিত রাজত্বে বিভক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় প্রায় সবগুলো রাজত্বই নতুন রাষ্ট্র ভারত ফেডারেশনে যোগ দেয়। কিন্তু হায়দ্রাবাদের নিজাম স্বাধীনতা দাবি করেন। এতে নয়াদিল্লির হিন্দু নেতারা খুবই অসন্তুষ্ট হন।

নয়াদিল্লি এবং হায়দ্রাবাদের মধ্যে এক দীর্ঘ তিক্ত অচলাবস্থার পর ভারত সরকার অবশেষে ধৈর্য্যহারা হয়ে পড়ে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের কেন্দ্রে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে প্রস্তুত নন।

তারা আরও আতঙ্কিত হয়ে পড় যখন হায়দ্রাবাদের সবচেয়ে শক্তিশালি মুসলিম রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র উইং কয়েকটি হিন্দু গ্রামে ত্রাস তৈরি করে। আর এ ঘটনাটিকেই অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু হায়দ্রাবাদে সামরিক অভিযান চালান। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দ্রাবাদ আক্রমণ করে।

ভারতের রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী সহজেই নিজামের বাহিনীকে পরাজিত করে। কিন্তু এরপর ভারতের রাষ্ট্রীয় বাহিনী মুসলিমদের ওপর এক ভয়াবহ নিধনযজ্ঞ চালায়। তারা মুসলিমদের ঘরবাড়ি গণহারে আগুনে পুড়িয়ে দেয়, লুটপাট চালায় এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গণহারে হত্যা ও গণধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটায়।

এসব ঘটনার খবর নয়াদিল্লিতে পৌঁছানেরা পর প্রধানমন্ত্রী নেহেরু একটি কমিশন প্রেরণ করেন এর তদন্ত করার জন্য। ওই তদন্ত দলে কয়েকজন মুসলিমও ছিলেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন পণ্ডিত সুন্দরলাল নামে এক কংগ্রেস সদস্য। কিন্তু ওই তদন্ত প্রতিবেদন আর কোনো দিনই প্রকাশ করা হয়নি।

সুন্দরলালের নেতৃত্বাধীন দলটি হায়দ্রবাদের প্রায় সবগুলো গ্রামই পরিদর্শন করে। ওই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া প্রতিটি গ্রামের মুসলিমদের সাক্ষ্য থেকে তারা একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। সেখানে বলা হয়, ‘আমরা এ ব্যাপারে অকাট্য সব তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় পুলিশ সদস্যরাই হত্যাযজ্ঞ, লুটপাট এবং অন্যান্য অপরাধে অংশগ্রহণ করেছে।’

‘তদন্তে আমরা এও তথ্য পেয়েছি যে, সেনা সদস্যরা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের মুসলিমদের বাড়িঘর ও দোকানপাট লুটপাটে উৎসাহ যুগিয়েছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সেনা সদস্যরা হিন্দুদের এসব অপরাধ করতে বাধ্য করেছে।’

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মুসলিমদের নিরস্ত্র করে সেসব অস্ত্র হিন্দুদের মাঝে বিতরণ করা হয়। ফলে হিন্দুরা মুসলিমদের ওপর তাদের জিঘাংসা চরিতার্থ করার সুযোগ পেয়ে যায়।

এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় সেনারা নিজেরাই হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অসংখ্য স্থানে সেনা সদস্যরা গ্রাম এবং শহরগুলো থেকে অসংখ্য মুসলিম যুবকদের ধরে নিয়ে এসে তাদের ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে।’

তবে তদন্তে এও বলা হয়, কয়েকটি স্থানে ভারতের সেনা সদস্যরা ভালো আচরণ করে এবং মুসলিমদের রক্ষা করে।

মুসলিমদের ওপর হিন্দুদের ওই হত্যাযজ্ঞকে অনেকে হায়দ্রাবাদের সশস্ত্র মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কর্তৃক হিন্দুদের ওপর চালানো বহু বছরের নিপীড়নের প্রতিশোধ হিসেবেও ব্যাখ্যা করে থাকেন।

সুন্দরলালের নেতৃত্বাধীন নেহরু কমিশনের প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত এক গোপন নোটে হিন্দুদের ওই নির্মম জিঘাংসার বিবরণ দেয়া হয় এভাবে, ‘অসংখ্য স্থানে আমরা পঁচতে থাকা মৃতদেহেপূর্ণ কুয়ো দেখতে পেয়েছি। এ রকম একটি কুয়োতে আমরা একত্রে ১১টি মৃতদেহ দেখতে পেয়েছি, যার মধ্যে শিশু সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখা এক নারীর মৃতদেহও রয়েছে।’

‘আমরা অসংখ্য মৃতদেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের টুকরো গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখতেও দেখেছি। অসংখ্য স্থানে মুসলিমদের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলতেও দেখেছি আমরা। মৃতদেহ পোড়ানোর পর অবশিষ্ট হাড়গোড় এবং মাথার খুলিও পড়ে থাকতে দেখেছি আমরা।’

সুন্দরলালের প্রতিবেদনে ২৭ থেকে ৪০ হাজার মুসলিমকে হত্যার কথা বলা হয়। সুন্দরলালের ওই প্রতিবেদন প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তের কারণ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু কোনো ব্যাখ্যা দেননি। তবে ধারণা করা হয়, ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর দেশব্যাপী হিন্দু ও মুসলিমদের মাঝে যে ব্যাপক হানাহানি শুরু হয় তা আরও বেড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় সম্ভবত নেহেরু ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেননি।

আর এটাও পরিষ্কার নয় যে, আজ কয়েক দশক পরে এসেও কেন ভারতের ইতিহাসের পাঠ্য পুস্তকগুলোতে ওই ঘটনার কোনো বিবরণ যুক্ত করা হয়নি। এমনকি আজও খুব অল্প সংখ্যক ভারতীয়ই সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল তা জানেন।

সুন্দরলালের রিপোর্ট আজও ধোয়াশাচ্ছন্ন রয়ে গেছে। যদিও সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে অবস্থিত নেহেরু স্মৃতি যাদুঘর এবং গ্রন্থাগারে ওই প্রতিবেদনের কপিটি প্রদর্শন এবং পাঠের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

1 comment:

  1. ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় যে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় তার এক বছর পর মধ্যভারতের হায়দ্রাবাদে এক গণহত্যার ঘটনা ঘটে।

    দেশ বিভাগের সময় সৃষ্ট দাঙ্গায় অসংখ্য মুসলিম লোকের প্রাণহানী ঘটে। তখন সিদ্ধান্ত হয়েছিল অন্যান্য রাজ্যগুলো তাদের ইচ্ছানুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তানে সাথে যোগ দিতে পারবে। অথবা স্বাধীন রাজ্য হিসেবেও থাকতে পারবে। যখন ত্রিবাঙ্কুর, যোধপুর, ভূপাল (যার নবাব ছিলেন মুসলমান) ভারতে যোগ দিতে অসম্মতি জানায় তখন কংগ্রেস ঐ সমস্ত রাজ্যে তাদের কর্মীদের দ্বারা গোলযোগ তৈরী করে রাজ্যগুলোক ভারতে মিশে যেতে বাধ্য করে। ফলে ১৯৪৭ এর ১৫ আগস্টের পূর্বেই হায়দারাবাদ, জুনাগর ও কাশ্মীর ছাড়া ভারতের প্রত্যাশিত সকল রাজ্যই ভারতে অন্তর্ভূক্ত হতে বাধ্য হয়। জুনাগরের মুসলিম নবাব পাকিস্তানে যোগদানের কথা ঘোষণা করার সাথে সাথেই কংগ্রেস কর্মীরা দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরী করে এবং ভারতীয় সৈন্যরা জুনাগর ঘেরাও করে ফেলে। নভেম্বরে ভারতীয় সৈন্য জুনাগরে প্রবেশ করে এবং দেশটি দখল করে নেয়। কাশ্মীরের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় যে, কাশ্মীরের জনগণ গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে তারা পাকিস্তানে না ভারতে থাকবে। কিন্তু পরে গণভোট আর হয়নি। কাশ্মীরকে জোর করে ভারত দখল করে নেয়।

    একইভাবে তখন হায়দ্রাবাদ জানিয়ে ছিল তারা ভারত বা পাকিস্তান কোনো রাষ্ট্রেই যোগ দিবে না। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই থাকবে। এতে নয়াদিল্লির হিন্দু নেতারা খুবই অসন্তুষ্ট হন। তখন হায়দ্রাবাদের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ছিল। নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা ছিল। সেনাবাহিনী ছিল। আইন আদালত ছিল। বিচার ব্যবস্থা ছিল। হাইকোর্ট ছিল। শুল্ক বিভাগ ছিল। নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়, পতাকা, ভাষা, জাতীয় সঙ্গীত, বিভিন্ন দেশে নিজেদের রাষ্ট্রদূত ও জাতিসঙ্ঘে নিজস্ব প্রতিনিধি ছিল। নয়াদিল্লি এবং হায়দ্রাবাদের মধ্যে এক বছরের দীর্ঘ তিক্ত অচলাবস্থার পর ভারত সরকার অবশেষে ধৈর্য্যহারা হয়ে পড়ে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের কেন্দ্রে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে প্রস্তুত নন। তখন জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, আমরা যখন প্রয়োজন মনে করব তখনই হায়দারাবাদের বিরূদ্ধে সেনা অভিযান পরিচালনা করব।” সে সময় নেহেরুর এই উক্তিকে হিটলারের মানসিকতার অনুরূপ বলে মন্তব্য করেছিলেন উইনস্টন চার্চিল।

    ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮-এ পুলিশের কথা বলে ৩৫ হাজার প্রশিক্ষিত সেনার একটি বহর পাঠানো হয়। সেনা বাহিনী আর্টিলারি, এয়ার সাপোর্ট এবং আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আচমকা হায়দ্রাবাদ আক্রমণ করে। ভারতীয় সৈন্যের বিপরীতে হায়দ্রাবাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্যের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয় হাজার। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ভারতীয় বাহিনীর সামনে হায়দ্রাবাদ সেনাবাহিনী টিকে থাকতে পারেনি। ভারতীয় সৈন্যরা প্রথমে এলাকার সকল পুরুষদের একত্রে গ্রেফতার করে একজায়গায় এনে হত্যা করত তারপর তাদের বাড়িতে গিয়ে মহিলাদের গণ ধর্ষণ করত এবং তাদেরও হত্যা করা হতো। নিরপেক্ষ জরিপে, মাত্র পাঁচদিনে দুই লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। “মহাত্না” গান্ধী বলেছিলেন, “If india leads a blood bath, she shall have it.” হায়দ্রাবাদের শাসক নিজাম তখন পাকিস্তান, আমেরিকা এবং জাতিসংঘের নিকট সাহায্যের জন্য আবেদন জানান। কিন্তু তিনি কোনো সাড়া পাননি। অবশেষে ব্যাপক সম্পদ ও জীবনহানি এড়ানোর জন্য ছয়দিনের মাথায় তিনি আত্নসমর্পণ করতে বাধ্য হন।

    https://ntnbd.net/letest-news/27118

    ReplyDelete