পাকিস্তানে একবার এবং ভারতে দুবার জামায়াত নির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধের স্বাদ পেয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী করেছিলেন আইয়ুবের ১১ বছর পর। বাংলাদেশ কখনো নির্দিষ্টভাবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেনি। গোলাম আযমের মামলার রায়ে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রকারান্তরে আক্ষেপ করেন এই বলে যে এই ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করেছেন। শান্তি কমিটি সংগঠিত করেছেন। রাজাকারদের শিবিরে শিবিরে বক্তৃতা করেছেন। পাকিস্তানের শত্রুদের ‘খতম’ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ এর দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হয়নি।
বাংলাদেশে জামায়াতবিরোধিতার একটা ঐতিহাসিক স্ববিরোধিতা ও পলায়নপরতা আছে। আমরা কথায় কথায় ১৯৯৬ সালের শেখ হাসিনা-মওদুদ-নিজামী আঁতাতের দৃষ্টান্ত টানি। কিন্তু ধর্মভিত্তিক দল নিয়ে আওয়ামী লীগের দ্বিধাদ্বন্দ্বের শিকড় অনেক গভীরে। আমাদের নেতাদের ঐতিহাসিক পলায়নপরতা আছে। ১৯৪৭ থেকে ভাষা ও স্বায়ত্তশাসন আমরা যত পরিষ্কারভাবে বুঝেছি এবং ধারণ করেছি, সেভাবে আমরা ধর্মের প্রশ্নে পারিনি। আমরা তাই প্রশ্ন তুলি, মুক্তিযুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতা কোথায় ছিল? বাহাত্তরের সংবিধানে এটা এল কোথা থেকে?
১৯৫৬ সালের ইসলামি প্রজাতন্ত্র সংবিধানকে (জিন্নাহর সেক্যুলার আদর্শ নাকচ করে) মাওলানা আবুল আলা মওদুদি ‘জামায়াতের বিজয়’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তখন তা নিয়ে পূর্ববঙ্গের উদারনৈতিক মুসলিম নেতাদের প্রকাশ্য রক্তক্ষরণ দেখি না। বরং ‘কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী আইন করা হবে না’—এই বাক্যের আড়ালে আওয়ামী লীগ আশ্রয় নিয়েছিল। সেক্যুলার স্বায়ত্তশাসন কারও অন্তরে থাকলেও, দু-একটি বিচ্ছিন্ন বিবৃতি মিললেও, আওয়ামী লীগ কখনো একে স্লোগানে-আন্দোলনে ঝাঁজালো করেছে বলে জানা নেই। ১৯৫৬ সালের ২১ জানুয়ারি করাচির গণপরিষদে শেখ মুজিব প্রস্তাবিত ইসলামি সংবিধানের তীব্র সমালোচনা করে দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। কিন্তু তাতে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের কথা বলেননি। এমনকি তিনি প্রকৃত ইসলামের পরিবর্তে ‘অইসলামি’ কিছু থাকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এ প্রসঙ্গ তুললাম এ কারণে যে জামায়াত নিষিদ্ধকরণ আদতে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের কতটুকু আদর্শিক অবস্থান, তা নিয়ে আমরা সন্দেহগ্রস্ত। এটা হয়তো শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক জুয়াখেলার অংশ। এতে তারা যেকোনো কিছু বাজি ধরতে পারে।
পাকিস্তান আমলে জামায়াতের গায়ে যুদ্ধাপরাধের কালিমা ছিল না। কিন্তু কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে দাঙ্গা বাধানো এবং সাম্প্রদায়িকতার নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। কাফের ঘোষণার দাবিতে ১৯৫৩ সালে জামায়াত দাঙ্গা করেছে। ২০১৩ সালে এসেও তারা ‘শাহবাগি’দের নির্বিচারে নাস্তিক ঘোষণা করতে বলছে। দাঙ্গা ও রক্তপাত নিশ্চিত করছে। ওই দাঙ্গা সামরিক আইন এনেছে। পুলিশ ও সেনার গুলিতে অন্তত ১৩ জন নিহত হয়। মওদুদি মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলেন। তখনকার মওদুদির সুর আর অসতর্ক খালেদা জিয়ার সুর যেন প্রায় একাকার হয়ে গেছে।
জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদি বিতর্কিত ইসলামি চিন্তাবিদ। বড় ভয়ংকর, ইসলামবিরুদ্ধ তাঁর দর্শন: হিন্দু-মুসলিম এক রাষ্ট্রে বাস করতে পারবে না।
ত্রিদেশীয় জামায়াতিদের গুরু মওদুদি। ৭২ বছর ধরে পাকিস্তানি ও বাঙালি জামায়াত একটি অসংজ্ঞায়িত ‘ইসলামি’ শাসনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতারাও ‘কোরআন-সুন্নাহর আইন’ কী তা নির্দিষ্ট করেননি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলাম প্রশ্নে মানুষকে ধাঁধায় রেখেছে। ১৯৫৩ সালে যা অমীমাংসিত ছিল, সেটা আজও অমীমাংসিত। পাঞ্জাবের দাঙ্গার তদন্তে বিচারপতি মুনিরের নেতৃত্বে কমিশন হয়েছিল। এই কমিশনের অভিজ্ঞতা শুনুন: ‘ইসলাম কী এবং মোমিন বা মুসলিম কে, আমরা ওলামাদের কাছে জানতে চাইলাম। কিন্তু তাঁরা এই প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। তাঁরা জিন্নাহর রাষ্ট্রদর্শন প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি এক জামায়াতি সদস্য বলেন, তাঁর (জিন্নাহর) আদর্শের রাষ্ট্র হলো শয়তানের সৃষ্টি।’ মুনির কমিশন মওদুদির কাছে জানতে চেয়েছিল, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ হলে ভারতীয় মুসলিমদের কর্তব্য কী হবে? মওদুদি তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী হওয়ার পরামর্শ দেন। বলেন, ‘পাকিস্তানবিরোধিতা তাদের উচিত হবে না।’
এই জামায়াত আইয়ুবের আমলে ২১ মাস নিষিদ্ধ থাকাকালে আমাদের পূর্বসূরিরা কী করেছিলেন? তখন বাংলাদেশে জামায়াতের ১৭টি অফিসে তালা মারা হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে জামায়াতের সঙ্গে জোট গড়তে তাদের বাধেনি। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের সঙ্গে জামায়াতের বিরোধ সামরিক শাসনে অরুচির কারণে ঘটেনি। আইয়ুবের যুগান্তকারী ধর্মনিরপেক্ষ আইনগুলো তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল। ওই আইনেই প্রথম স্ত্রীর সম্মতিতে দ্বিতীয় বিয়ের শর্ত আরোপ করা হয়। জামায়াতি ফতোয়া ছিল, এটা ইসলামের প্রতি হামলা। বিরোধী রাজনীতিকেরা আইয়ুবের অপসারণে ওই সময়ে কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি (কপ) করেছিলেন। ওই আইন বাতিল ছিল তাঁদের নয় দফার অন্যতম। জামায়াতকে ব্যবহার করাটা কপ নেতাদের দরকার ছিল। মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, মোজাফ্ফর আহমদ, ওয়ালি খান, মাওলানা মওদুদি প্রমুখ তাতে সই করেছিলেন।
সুতরাং বাংলাদেশ পর্বে আমরা জামায়াতের সঙ্গে যে আপস দেখি, তা আকাশ থেকে পড়েনি। ওই কৌশলগত মৈত্রীর শিকড় পাকিস্তানি ইতিহাসে প্রোথিত। খেলাফত মজলিশের সঙ্গে গোপন শরিয়া চুক্তির সদুত্তর আওয়ামী লীগ আজও দেয়নি। একশ্রেণীর আওয়ামী লীগ-সমর্থক বুদ্ধিজীবী এটা আমাদের ভুলিয়ে রাখেন। তাঁরা আমাদের হাতি দেখান এই বলে যে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে ১৯৯৬ সালে জোটে নেয়নি। অথচ কাগজে-কলমে এটুকু বাদে বাস্তবে কোনো কিছুই বাকি রাখেনি। আবদুস সামাদ আজাদের বাসভবনের বৈঠকগুলোতে জামায়াতিরাও প্রাণ সঞ্চার করেছেন।
আমরা এগুলো স্মরণ করছি আওয়ামী লীগকে খাটো কিংবা খোঁটা দেওয়ার জন্য নয়; আমরা আসলে কী এবং কতটা কী করতে পারি, সেটা হূদয়ঙ্গম করার জন্য। আয়নায় চেহারা দেখার জন্য। ষাটের দশকে একবার সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে আট বা নয়জন নেতার একটি যুক্ত বিবৃতি বিরাট সাড়া জাগাল। তাতে শেখ মুজিব এবং গোলাম আযমও আছেন। তারও আগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও মাওলানা ভাসানী মওদুদির সঙ্গে আপসের কিংবা ‘কৌশলগত রাজনীতি’ করে গেছেন। এই ধারার কি অবসান ঘটেছে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন অর রশিদ অকপটে বলছেন, ‘রাজনীতির খেলার অংশ হিসেবেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে সরকার। এ থেকে নির্বাচনী ফায়দা নেবে তারা।’
১৯৬৪ সালে আমাদের তারকা ছাত্ররাজনীতিকদের একটি বিবৃতি দেখে কিছুক্ষণ থ হয়ে থাকলাম। আইয়ুবের জামায়াত নিষিদ্ধকরণ তাঁদের মতে ‘গণতন্ত্রের ওপর বর্বর হামলা’। ১৯৬৪ সালের ১০ জানুয়ারি ১৮ জন ছাত্রনেতা বলেন, ‘জামায়াতকে বেআইনি ঘোষণা দেশের বুক হইতে গণতন্ত্রের নাম-নিশানা মুছিয়া ফেলিবার ষড়যন্ত্রের একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।’ জামায়াতের নেতাদের মুক্তি দাবি করে তাঁরা ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার’ বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজকে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি ও জিএসের সই আগে। তাঁরা হলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী। আরও আছেন সেই সময়ের ছাত্রলীগের নেতা সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক।
গতকাল ফোন করি রাশেদ খান মেননকে। ‘আমি এই বিবৃতির কথা বিন্দুমাত্র স্মরণ করতে পারি না।’ মেননের উত্তর। হায়দার আকবর খান রনো বিবৃতিদাতাদের অন্যতম। স্মরণে আনতে তাঁরও কষ্ট হলো। তারপর বললেন, ‘আমরা তখন ছাত্র। আর জামায়াতের চেয়ে সামরিক জান্তা বেশি ঘৃণিত ছিল।’ এই নীতিহীন কৌশলগত যুক্তি আজও চলছে। স্বৈরশাসক এরশাদ যখন ‘বেশি ঘৃণিত’, তখনকার পক্ষ-বিপক্ষ আর আজকের পক্ষ-বিপক্ষ এক নয়। রনো ধন্যবাদার্হ্য। কারণ তিনি স্বীকার করেন যে সুবিধা অনুযায়ী রাজনীতি করার রোগ আমাদের আছে। জনাব মেনন অবশ্য এটুকু স্মরণ করেন যে ‘আইয়ুবের ওই আইনের বিরোধিতা আমরা চাইনি। কিন্তু নেতাদের কাছে আমাদের আপত্তি টেকেনি।’
স্ববিরোধিতার কফিনের শেষ পেরেক পঞ্চম সংশোধনীর রায়। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কখন কী বলেন, কখন কী পারেন আর কী পারেন না, তা বলা বড় মুশকিল। সরকারের দরকার পড়ল পঞ্চম সংশোধনীর রায়মতে একটি সংবিধান ছাপিয়ে নেওয়া। ব্যস, ‘বাঘা’ সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মত দিলেন। টাকশালে টাকা ছাপানোর মতো নতুন সংবিধান ছাপা হলো। সেখানে জামায়াতসহ সব ধর্মীয় দল নিষিদ্ধ হলো। কিন্তু তখন অন্য হিসাব, অন্য কৌশল। কী অদ্ভুত দেশ এবং তার দেউলিয়া রাজনীতি। সর্বোচ্চ আদালত জামায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। সংবিধান ছাপিয়ে তা কার্যকর আইনি রূপও দিল। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী তা স্বীকার করল না বলে সমাজে এর কোনো ছাপ পড়ল না। কোনো উচ্চবাচ্য হলো না। ১৫তম সংশোধনীতে তা নীরবে মুছে ফেলা হলো।
নির্বাচন কমিশন ও সরকারি নথিপত্রে পঞ্চম সংশোধনী মামলায় দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দিন থেকে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সময়ে জামায়াতসহ ধর্মীয় নামযুক্ত কোনো দলের বৈধ অস্তিত্ব থাকতে পারে না। সে হিসেবে এ দেশে সাংবিধানিক কারণে জামায়াত রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছে দুবার। এবার তৃতীয়বারের পালা।
আসলে সুশাসন ও আইনের শাসন অভ্যাসগতভাবে প্রত্যাখ্যান করে চলা আমাদের শাসকগোষ্ঠী পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সে কারণে তাদের কাজে-কর্মে ও অঙ্গীকারে অস্বচ্ছতার কোনো খামতি নেই। প্রচলিত আইনে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে তা টেকানো কঠিন মনে হয়। ভারত জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে তা সুপ্রিম কোর্টে টেকাতে পারেনি। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শেখার আছে।
http://webcache.googleusercontent.com/search?q=cache:58ffg_FTCKQJ:www.prothom-alo.com/detail/date/2013-03-23/news/338769+&cd=1&hl=en&ct=clnk&gl=uk
No comments:
Post a Comment