Saturday, 22 June 2013

রানা প্লাজা ট্রাজেডি : রেশমা ‘উদ্ধার’ নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য

সাভারের রানা প্লাজা ধসের প্রথম দিনেই বের হয়ে এসেছিলেন আলোচিত গার্মেন্ট কন্যা রেশমা। সামান্য আহত রেশমা এরপর সাভারের একটি হাসপাতালে চিকিত্সাও নেন। আমার দেশকে এসব তথ্য জানিয়েছেন রেশমার সঙ্গে বের হয়ে আসা নিউ ওয়েব স্টাইল গার্মেন্টের লাইনম্যান এবং রেশমার এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী।
মাত্র চারটি বিসু্কট ও এক বোতল পানি খেয়ে রেশমার দিনের পর দিন বেঁচে থাকা এবং পরিপাটি নতুন পোশাকে উদ্ধার হওয়ার ঘটনা নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক রহস্য সৃষ্টি হয়। এ ঘটনার সত্যাসত্য সম্পর্কে জানার জন্য অনুসন্ধান চালায় আমার দেশ।
ঘটনাস্থল সাভার, রেশমার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, গত ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর প্রথম দিনই ভবনের ভেতর থেকে আহত অবস্থায় বের হয় রেশমা। তাকেই আবার কথিত ১৭ দিন পর ‘উদ্ধার’ করা হয়। ‘উদ্ধার’ হওয়া ‘অলৌকিক কন্যা’ রেশমাকে নিয়ে শুধু দেশের মিডিয়াই নয়, আন্তর্জাতিক মিডিয়াও বেশ মাতামাতি করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেশমা উদ্ধারের কাহিনী ছিল একটি সাজানো নাটক। কিন্তু রেশমাকে নিয়ে কেন সাজানো হলো এই নাটক?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ওই সময়ে হেফাজতের ওপর গণহত্যা, বিরোধীদল দমন-পীড়ন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আন্তর্জাতিক নিন্দা, উদ্ধার অভিযানে ব্যর্থতাসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন ইস্যু চাপা দিতেই এ নাটক সাজানো হয়।
বিনিময়ে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন দিন আনে দিন খাওয়া রেশমাকে তার হতাশাপূর্ণ জীবনের অধ্যায় শেষ করে আমেরিকা যাওয়া অথবা দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পছন্দের একটিতে ৬০ হাজার টাকা বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়েছে এবং এরই মধ্যে তাকে লোভনীয় বেতনে একটি পাঁচতারা হোটেলে চাকরি দেয়া হয়েছে।
রেশমাকে উদ্ধারের প্রকৃত ঘটনা জানতে তার মা জোবেদা, বোন আসমা, তার গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী, সাভারে ভাড়াটিয়া বাসার মালিক দম্পতি, সেখানকার প্রতিবেশী, রেশমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী রুমা, নিউওয়েভ স্টাইল গার্মেন্টের তৃতীয় ফ্লোরের লাইনম্যান এনামুল, ভবনের পাশের ক্যান্টিন মালিক আলম, রানা প্লাজার কয়েকজন দারোয়ান, নিউওয়েভ স্টাইলের তিনতলা ও ৭ তলার শ্রমিক রাজা, ময়না, জসিমসহ বেশ কয়েকজন শ্রমিক, উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া স্থানীয় বহু লোক এবং রানা প্লাজার পাশের মজিদপুরের বহু বাসিন্দা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে আমার দেশ।
গত ১০ মে রানা প্লাজার ধ্বংসাবশেষ থেকে রেশমাকে উদ্ধারের দাবি করা হয়। এ ঘটনা সারাবিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করে। তাত্ক্ষণিকভাবে এমন ‘অলৌকিক ঘটনা’য় বাংলাদেশসহ পুরো দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ বিমোহিত হয়ে পড়েন। একটি জীবনের ‘জয়গানে’ তারা ভুলে যায় ১১২৭টি তাজা প্রাণের লাশ হয়ে যাওয়ার দুঃখ! সর্বত্র চলে হই-হুল্লোড়।
এভাবে অল্প কিছুক্ষণ চললেও সচেতন লোকেরা মোহ কাটিয়ে উঠতে থাকে খুব দ্রুতই। তারা বিশেল্গষণ শুরু করে দেন ‘উদ্ধার’ অভিযানের ঘটনা। খুঁটিনাটি বিশ্লেষণের পর ওইদিনই ভার্চুয়াল জগতে রটে যায়, ‘রেশমার উদ্ধার একটি নাটক’! ১১শ’ লাশের দুঃখ ভুলিয়ে দিতে আবেগপ্রবণ বাঙালির জন্য এটি মঞ্চস্থ করা হয়েছে!
তাত্ক্ষণিকভাবে এই সন্দেহবাদীদের কথা অনেকে উড়িয়ে দিলেও তাদের তুলে দেয়া কিছু প্রশ্নের কোনো উত্তর কেউ দিতে পারেনি। এসব উত্তর খুঁজতে অনুসন্ধান শুরু করে দৈনিক আমার দেশ। এরপর থেকেই বের হতে থাকে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
উদ্ধার হওয়া মেয়েটি কী ‘রেশমা’ না ‘জয়া’, নাকি ‘ফাতেমা’?: ‘উদ্ধার হওয়া রেশমার নাম নিয়েও ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। মা বলেছেন নিউওয়েভ গার্মেন্টে তার কার্ডে নাম ছিল জয়া। বোন বলেছে তার নাম জয়া নয়। তার কার্ডে নাম ছিল ফাতেমা। অফিসের লাইনম্যান জানিয়েছেন তার নাম জয়া। রেশমার ভাড়া বাসা বাড়ির মালিক জানেন রেশমা নামে। কিন্তু সেনাবাহিনীর উদ্ধার কর্মীর একটি দল জানায়, তার নাম ‘রেশমা’। কিন্তু তার মা জোবেদা বেগম এবং গ্রামের লোকজন বলেছেন, তার আসল নাম ‘জয়া’।
তাহলে রেশমা নাম এলো কী করে? এ প্রশ্নের জবাবে তার মা বলেন, রেশমা ডাকনাম। কিন্তু ভবন ধসের পর মা ও বোন মিলে প্রকৃত নামেই (জয়া) কার্ড ছাপিয়ে সাভারে গিয়ে তাকে খুঁজেছেন। ওই কার্ডের ছবিও আমার দেশ সংগ্রহ করেছে। তবে সাভারের ব্যাংক কলোনি এলাকার ভাড়াটিয়া বাসার মালিক নুরু মিয়া ও তার স্ত্রী হাজেরা বেগম ‘রেশমা’ হিসেবেই তাকে চেনেন।
আবার ‘রেশমা’র বড় বোন আসমা, যিনি তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং রানা প্লাজার নিউ ওয়েভ স্টাইলে চাকরি জোগাড় করে দেন, তিনি আমার দেশ-কে জানিয়েছেন, ‘রেশমা’ ‘ফাতেমা’ নামে এখানে কাজ নেয়। তার নাম জয়া নয় বলেও জানান আসমা। কারণ হিসেবে জানান, গার্মেন্টেসে জন্ম নিবন্ধনের সার্টিফিকেট দরকার ছিল যা রেশমার ছিল না। তাই অন্য এক ফাতেমার নাম দিয়ে সে ওই গার্মেন্টে কাজ নেয়।
কিন্তু রহস্যজনকভাবে আসল নাম ‘জয়া’ এবং গার্মেন্টে এন্ট্রি করা নাম ‘ফাতেমা’র কথা কেউ বলেননি। এনাম মেডিকেলে ২৪ তারিখ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত আহতদের তালিকায় ফাতেমা নামে একজনের ভর্তি হওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। ওই নাম তালিকার প্রথম দিকেই রয়েছে।
২৪ এপ্রিলই রানা প্লাজা থেকে এনামুলের সঙ্গে বের হয়ে আসেন রেশমা : রেশমা তিনতলার যে কোম্পানিতে (নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেড) কাজ করতেন, ওই প্রতিষ্ঠানেরই ‘লাইনম্যান’ হিসেবে কাজ করতেন গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গার এনামুল। এনামুল জানান, এ ঘটনার পর থেকেই বাড়িওয়ালার সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। তবে ভবন ধসে পড়ার পর সে কিছুটা আহত অবস্থায় বের হয়ে আসে। দু’দিন এনাম হাসপাতালে চিকিত্সা নিয়ে সে গাইবান্ধায় চলে যায়। ১০ মে রেশমা ‘উদ্ধার’ ঘটনার পরে ভেতরে থাকা রহস্যের ব্যাপারে জানার জন্য বহু চেষ্টা করেও এনামুলকে ঢাকায় আনা যায়নি। বিভিন্ন মোবাইল থেকে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি। অবশেষে ‘রানা প্লাজায় নিখোঁজ রেশমা নামক একজনের বোন’ পরিচয়ে বেশ কয়েকদিন তার সঙ্গে কথা বলা হয়। যোগাযোগের একপর্যায়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলে অনেক বিষয়ে (মোবাইল নং- ০১৭৭৮০০০৩৩৪) কথা বলেন এনামুল।
একপর্যায়ে নিজের বের হয়ে আসার ঘটনাসহ রেশমার ব্যাপারেও তথ্য দেন। এ সময় এনামুল জানান, তিনি এক রেশমাকেই চেনেন। তার আসল নাম ‘জয়া’ (যাকে ‘১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয়েছে’)। এনামুল স্বীকার করেন, এ রেশমা ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের ঘটনার সময় তার পেছন পেছন বের হয়ে আসেন। এ সময় রেশমাও আহত অবস্থায় এনাম হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত এনামুল দুদিন পরে হাসপাতাল ছাড়ার সময় আর রেশমাকে খুঁজে পায়নি। এরপর তার সঙ্গে রেশমার বাড়িওয়ালার যোগাযোগ হয়। বাড়িওয়ালা ফোনে রেশমাকে হাসপাতালে পেয়েছেন বলেও নিশ্চিত করেছেন এনামুলকে। এনামুলের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলার একপর্যায়ে তিনি জানান, দুদিন রেশমা এনাম মেডিকেলে ভর্তি ছিলেন। তারপর ওখান থেকে ক্যান্টমেনটে চলে যায় বলে শুনেছি। এরপর আর রেশমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি।
কিন্তু এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে শুরু করলে সে ফোন কেটে দেয়। এরপর একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে সে ক্ষিপ্ত হয়। আলাপচারিতায় প্রথম পর্যায়ে এনামুল দাবি করে রেশমার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সে বিবাহিত জানার পর আর পাত্তা দেয়নি। এনামুলের সঙ্গে এসব কথোপকথনের সব রেকর্ড রয়েছে আমার দেশ-এর হাতে।
অক্ষত গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকেই ‘উদ্ধার’ করা হয়েছিল রেশমাকে : রানা প্লাজা ধসের ঘটনার শুরু থেকে উদ্ধার অভিযানের শেষ পর্যন্ত অক্ষত ছিল গ্রাউন্ড ফ্লোর। গ্রাউন্ড ফ্লোরের চারপাশটা ধ্বংসস্তূপে ঢাকা ছিল মাত্র। তাই ঘটনার দিনই মালিক সোহেল রানাকে আর এস টাওয়ারের ভেতর থেকে জানালা ভেঙে গ্রাউন্ড ফ্লোর দিয়ে উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই একই জায়গা থেকে ১৭ দিন পর রেশমাকেও ‘উদ্ধার’ করার দাবি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, পুরো ৯ তলার ৮টা ফ্লোরের ধ্বংসস্তূপ একসঙ্গে ধসে পড়েনি। তিনতলা পর্যন্ত অক্ষত ছিল কয়েকদিন। পরে বাকি ফ্লোর ধসে পড়লেও গ্রাউন্ড ফ্লোরের ছাদ সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল। তাই তিনতলা থেকে কারও বেজমেন্টে পড়ার সুযোগ নেই। এমনকি মসজিদের সঙ্গে সিঁড়ির পথ ধ্বংসস্তূপের কারণে একেবারেই বন্ধ থাকায় কেউ ওই পথে যেতে পারেনি। তাই সিঁড়ির পথ দিয়েও গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে আসার মতো ব্যাপারটিও অবিশ্বাস্য।
শুধু তাই নয়, গ্রাউন্ড ফ্লোরের ছাদ অক্ষত থাকায় উদ্ধার অভিযানের সময় এলাকাবাসী রানা প্লাজার দুপাশের আর এস টাওয়ার ভবন ও গুদামঘর থেকে অক্ষত গ্রাউন্ড ফ্লোর পর্যন্ত সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করে নিয়েছিলেন। অথচ রেশমাকে উদ্ধারের পর তাত্ক্ষণিকভাবে বলা হয়, তাকে বেজমেন্টের মসজিদ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। আরও বলা হয়, রেশমা ধসের সময় তিনতলায় ছিল। পরে দ্বিতীয় ও গ্রাউন্ড ফ্লোর ধসার পর সে বেজমেন্টের মসজিদে পড়েছিল।
কিন্তু রানা পল্গাজার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করা এবং উদ্ধার অভিযানে প্রথম থেকেই অংশ নেয়া স্থানীয় বাসিন্দা ও শ্রমিক রাজা, আলম, রবিউল, জসিম, মিলনসহ অনেকে জানান, গ্রাউন্ড ফ্লোর ধসেনি। তাই তিনতলা থেকে পড়ে বেজমেন্টের মসজিদে কারও যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রেশমাকেও কথিত উদ্ধারের সময় আর এস টাওয়ারের ভেতর থেকে বের করা হয়েছে।
রেশমা উদ্ধারের তিনদিন আগে রানা প্লাজার তিনদিকে ছিল অঘোষিত ‘কারফিউ’: রেশমাকে উদ্ধারের ঘটনার তিনদিন আগে থেকে ছিল অঘোষিত কারফিউ। ওই তিনদিনে রানা প্লাজার চারপাশে কাউকে ঘেঁষতে দেয়া হয়নি।
এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিপুলসংখ্যক র্যাব, বিজিবি সদস্য এবং সেনাসদস্য ওই এলাকা ঘিরে রাখে। রানা প্লাজার চারপাশের বাড়িঘরের সামনে গেটে নক করে সন্ধ্যার আগেই বন্ধ করা এবং কোনোভাবেই বের না হওয়ার জন্য হুশিয়ার করে দেয় তারা।
রানা পল্গাজার সামনে (উত্তর দিকে) ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। পূর্ব-পশ্চিম দিকে মার্কেট ও দোকানপাট এবং দক্ষিণ দিকে মজিদপুর আবাসিক এলাকা। ১০ মে বিকাল সাড়ে চারটায় রেশমাকে উদ্ধারের আগে ৭ তারিখ থেকে রানা প্লাজার পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দোকানপাটগুলো সন্ধ্যার পরপরই বন্ধ করে দেয়া হতো। আর দক্ষিণ দিকের আবাসিক এলাকায় সবচেয়ে কাছে থাকা হোসনে আরা বেগমের বাড়িসহ কয়েকটি বাড়ির বাসিন্দাদের ৭ তারিখ সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। হোসনে আরা বেগমের বাড়ির লোকজনসহ কয়েকটি বাড়ির মালিক জানান, কোনো কারণ ছাড়াই নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন এসে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে ৫-৬ দিনের জন্য এলাকার বাইরে গিয়ে থাকার আদেশ দেন। ফলে তারা বাড়িঘর ছেড়ে চলে যান। ফিরে আসেন রেশমা উদ্ধারের ঘটনার ২ দিন পর। কি কারণে তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বলা হয়েছিল সে ব্যাপারেও তাদের জানার কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি।
রানা প্লাজার ৩০০ গজ দূরত্বের পর থাকা মজিদপুরের অনেক বাড়ির গেটে সন্ধ্যার পর থেকেই দুজন করে সেনাবাহিনীর সদস্য অবস্থান নিয়ে বাসিন্দাদের দরজা বন্ধ করে ভেতরে থাকার নির্দেশ দেয়। ৮ ও ৯ মে একইভাবে চলে। কিন্তু ১০ মে বিকালে রেশমা উদ্ধারের পর আর কোনো নিরাপত্তা টহল ছিল না ওইসব এলাকায়।
মজিদপুরের ‘কাশেমের দোকান’র মালিক কাশেম মিয়া, ক্যান্টিন মালিক আলম, হোসনে আরা বেগমের বাড়ির লোকজনসহ আরও অনেকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তারা বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর এ ধরনের আচরণে তারা মনে করেছিলেন যে রাতের অন্ধাকারে ধ্বংসস্তূপের সঙ্গে গাড়ি ভর্তি লাশ গুম করার জন্যই এমনটা করা হচ্ছে। কারণ শাহীনার ঘটনার পর থেকে দিনের বেলায় লাশ উদ্ধার করার কোনো নজির নেই। সব লাশ উদ্ধার করা হয়েছে রাতের অন্ধকারে।
স্বামীর মারধরের কারণেই রেশমার হাতে দাগ : রেশমাকে উদ্ধারের পর এএফপির ছবি দেখিয়ে অনেককে বলতে শোনা গেছে, ‘এটা নাটক হলে হাতে এতো দাগ থাকত না। ধ্বংসস্তূপ থাকার কারণে হাত থেতলে গিয়ে এমন হয়েছে।’
এ ব্যাপারে জানতে ২২ মে সকাল ১০টায় দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট এলাকায় রানীগঞ্জ বন্দরের কুশিগাড়ি গ্রামে রেশমার বাড়ি যান স্থানীয় সাংবাদিক মো. মোখলেসুর রহমান সওদাগরসহ আমার দেশ-এর তিন প্রতিবেদক। মাটির দেয়াল ও ছনের চালাবিশিষ্ট ঘরের সামনে বসেছিলেন রেশমার মা জোবেদা বেগম ও খালাসহ স্থানীয় কিছু নারী-পুরুষ। তার আগের দিন সকালে অর্থাত্ ২১ মে রেশমার মা ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। এ সময় রেশমার মা জোবেদা বেগম তার মেয়ে জামাই কিভাবে মেয়ের ওপর নির্যাতন চালাতো সেসব ব্যাপারে তুলে ধরেন।
অন্যদিকে তার আগে সাভার ব্যাংক কলোনিতে রেশমার ভাড়া বাসার মালিক নুরু মিয়া জানান, স্বামী রাজ্জাকের অমানুষিক নির্যাতনে বাধ্য হয়ে তাকে ডির্ভোস দেয় রেশমা। নুরু মিয়া বলেন, রেশমার হাতে যত দাগ আছে সেগুলো তার স্বামীর সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ। নুরুর স্ত্রী হাজেরা বেগম আরও জানান, রেশমার এক হাতে লম্বা একটা কাটার দাগ আছে, সেটিও রাজ্জাকের নির্যাতনের চিহ্ন। রেশমার স্বামীর নির্যাতনের বর্ণনার ব্যাপারে রেশমার মা ও বাড়িওয়ালার কথার মিল রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনের সময় রেশমার হাতে অনেক আগের পুড়ে যাওয়া সিগারেটের দাগ দেখা গেছে। জোবেদা বেগমের দেয়া তথ্য অনুযায়ী রেশমার স্বামী আবদুর রাজ্জাকের বাড়ি ঘোড়াঘাট উপজেলার বিরামপুরের ইউনিয়নের মণ্ডপপাড়া গ্রামে। সেখানে সরেজমিনে গেলে আবদুর রাজ্জাককে পাওয়া যায়নি।
বেজমেন্টে কোনো দোকান ছিল না : রেশমার ‘নতুন’ ড্রেস পরার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সেনা কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেখানে সে পড়েছিল সেখানে কয়েকটি কাপড় ও খাবারের দোকান ছিল। ১৭ দিন ধ্বংসস্তূপে থাকার কারণে তার গায়ের কাপড় ছিঁড়ে যাওয়ায় উদ্ধারের আগে সে ওইসব দোকানের একটি থেকে কাপড়গুলো সংগ্রহ করে রেশমা নিজেই গায়ে দেয়।’ কিন্তু রানা পল্গাজার গার্ড রবিউল, আবদুল মজিদ, সাততলার সিকিউরিটি গার্ড মীর দেব, ক্যান্টিন মালিক আলম, স্টোর শ্রমিক সরোয়ার,এবং ভবনে কাজ করা অন্য জীবিত শ্রমিকরা জানান, বেজমেন্টে কোনো দোকান ছিল না। সেখানে ছিল গাড়ি পার্কিং, বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার এবং মসজিদ। সাভারের অন্যান্য বহুতল ভবনগুলো ঘুরে দেখা গেছে ওই এলাকায় কোথাও বেজমেন্ট ফ্লোরে দোকান রাখার প্রচলন নেই। আলম জানান, রানা প্লাজা নির্মাণের পর থেকে তার এই ক্যান্টিন। তিনি প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী বেইজমেন্টে কোনো খাবারের দোকান এবং কাপড়ের দোকন ছিল না।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, একাধিকবার জামা পরিবর্তন করেছেন রেশমা। এমনকি রেশমার দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী তিনি যখন প্রথম তিনতলায় আটকে ছিলেন তখন তার সামনে মাত্র ১০ ইঞ্চি ফাঁকা ছিল। ওই ফাঁকার মধ্যে রেশমার ম্যাচিং করা ড্রেস পড়া অসম্ভব। তাছাড়া তিনতলায় কোনো দোকান ছিল না। ছিল শুধু গার্মেন্ট, যেখানে এ ধরনের পোশাক তৈরি হয় না।
শাহীনাকে উদ্ধারে ব্যর্থতার পর উদ্ধারকারীদের ভিন্ন আচরণ : গার্মেন্ট শ্রমিক শাহীনাকে জীবিত উদ্ধারে ব্যর্থতা নিয়ে মিডিয়ায় সমালোচনা ও এলাকাবাসীর রোষানলে পড়ে নিরাপত্তা বাহিনী। ঘটনার পর প্রথমে বলা হয়েছিল, ৭২ ঘণ্টা পর জীবিত পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় উদ্ধার অভিযান বন্ধ করা হবে। কিন্তু এরপর বিশেষ বিবেচনায় অভিযান চলার সময় ঘটনার ১০৮ ঘণ্টা পরে শাহীনা নামক জীবিত এক মহিলার সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর তাকে জীবিত উদ্ধারের জন্য ২৯ ঘণ্টা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় উদ্ধারকারী দল। ব্যর্থ হওয়ায় এলাকার স্থানীয় উদ্ধারকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এ সময় দু’পক্ষ থেকেই ইটপাটকেল ছুড়ে মারার ঘটনাও ঘটে।
স্থানীয় উদ্ধারকারীরা জানান, এর পর থেকেই নিরাপত্তা বাহিনীর আচরণ অন্যরকম হয়ে যায়। তারা কাউকেই আর ধ্বংসস্তূপের আশপাশে ঢুকতে দেয়নি। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের লোকজনকেও তারা ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কোনো কারণ ছাড়াই রানা প্লাজার সঙ্গে গুদামঘর-লাগোয়া মজিদপুর রোডটি বন্ধ করে দিয়ে গুদামঘরের গেট তালাবদ্ধ করে দেয়া হয়।
শতাধিক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, রেশমাকে গুদামঘর থেকে ঢোকানো হয়েছে। উদ্ধার দেখিয়ে আরএস টাওয়ার থেকে বের করা হয়েছে। রেশমাকে যাতে কেউ না দেখে সেজন্য সবার দৃষ্টির আড়ালে আগেভাগেই তারা নাটকের মঞ্চ তৈরি করে রাখেন।
এসব ঘটনার সময়ে কোনো সাংবাদিককে রানা প্লাজার ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেয়া হয়নি। দূর থেকে ফুটেজ ও ছবি নিতে হতো।
রেশমাকে উদ্ধারের পর স্থানীয় অনেকে এই প্রতিবেদকের কাছে মন্তব্য করেছেন, শাহীনাকে উদ্ধারের ব্যর্থতা ভোলাতে নিরাপত্তা বাহিনী রেশমাকে ‘উদ্ধার’ করেছে।
শুধু রাতের অন্ধকারে উদ্ধার অভিযান নিয়ে এলাকায় ক্ষোভ : শাহীনার ঘটনার পর থেকে সরকারের উদ্ধারকারীরা দিনের বেলায় কোনো উদ্ধার অভিযান চালায়নি। রাতের অন্ধকারে উদ্ধারকাজ চালানোয় স্থানীয়া ক্ষুব্ধ ছিল। উদ্ধারকাজের আড়ালে অন্যকিছু ঘটছে কিনা এমন সন্দেহ থেকে তারা রাতের বেলা সাভার এলাকায় চলাচলকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি তল্লাশি করে। কিন্তু ৭ মে সন্ধ্যা থেকে অঘোষিত কারফিউয়ের অবস্থা সৃষ্টি করায় ১০ মে রাত পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দারা কোনো গাড়ি তল্লাশি করেনি।
রেশমাকে আমেরিকা পাঠাতে চায় সরকার : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের সাজানো নাটক যাতে প্রকাশ না হয়, সেজন্য রেশমাকে বিদেশ পাঠাতে মরিয়া সরকার। এ সুযোগ ছাড়তে নারাজ পরিবারও। তবে তারা চায় রেশমার হাত ধরে সপরিবারে আমেরিকা পাড়ি জমাতে। কিন্তু সরকার চায় শুধু রেশমাকে পাঠাতে। রেশমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
জোবেদা বেগম যা বলেন তা হুবহু তুলে ধরা হলো—‘উদ্ধারের পর প্রধানমন্ত্রী জোবেদা বেগমের হাতে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন। রেশমাকে দুটি শাড়ি ও একটি চাদর দিয়েছেন। এছাড়াও গার্মেন্ট মালিকও রেশমাকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন। আরও অনেকে অনেক টাকা দিয়েছেন (নাম বলতে পারেননি)। রানা প্লাজায় সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী টিমের প্রধান (জিওসি) রেশমার কাছে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছেন, রেশমা কি আমেরিকা যেতে চায়, নাকি দেশে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে যে হোটেল (হোটেল রেডিসন) আছে সেখানে চাকরি করতে চায়? রেশমা বলেছে, সে আমেরিকা যেতে চায় না। দেশে ওই হোটেলে চাকরি চায়। ওই হোটেলে চাকরি করলে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন রেশমার বেতন হবে ৩৫ হাজার টাকা এবং অন্যান্য সুবিধাসহ তার মোট বেতন হবে ৬০ হাজার টাকা।’ আপনারা পরিবারের লোকজন কি চান—জানতে চাইলে রেশমার মা বলেন, ‘আমরা বলেছি রেশমা একা যাবে না। গেলে পরিবারের সবাই যাব। রেশমাও তা-ই বলেছে।’
রেশমার লেখাপড়া কী করেছে—জানতে চাইলে জোবেদা বেগম বলেন, ‘দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়েছে মাত্র। বেশি লেখাপড়া জানে না আমার মেয়ে।’
রেশমার প্রতিক্রিয়া : গত ৬ জুন হোটেল ওয়েস্টিনে যোগদানের সময় সংবাদ সম্মেলনে রেশমার কাছে জানতে চাওয়া হয়, রানা প্লাজা ধসের সময় তিনি লাইনম্যান এনামুলের সঙ্গে বেরিয়ে আসেন। দুই দিন তিনি এনাম মেডিকেলেও চিকিত্সা নিয়েছিলেন।
এ কথা শুনে তিনি চমকে ওঠেন। কয়েক সেকেন্ড সময় নেন। তারপর চিত্কার করে বলেন, কী বললেন?
আবার তাকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি যে গার্মেন্টে কাজ করতেন, ওই গামেন্টের লাইনম্যান এনামুলকে তো আপনি চেনেন, তা-ই না? জবাবে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ উত্তর দেননি রেশমা। তবে তিনি লাইনম্যান এনামুলকে অস্বীকারও করেননি। পরে রেশমা বলেন, ‘আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে আপনি ছিলেন না। তাই আমার যে কী কষ্ট হয়েছে, আপনি জানেন না। আপনি ভুল কথা বলছেন।’ এরপর আর কোনো কথা বলেননি রেশমা।
এ সময় ওয়েস্টিনের কর্মকর্তারা বলেন, রেশমাকে কেউ এ ধরনের ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারবেন না।
প্রথম ছবিতেই অসঙ্গতি : রেশমাকে উদ্ধারের পর বার্তা সংস্থা এএফপির ছবিতে দেখা যায়, রেশমার হাতের নখ খুবই ছোট, ১৭ দিন না কাটলে যা এর চেয়ে কয়েকগুণ বড় হওয়ার কথা। চিকিত্সা বিজ্ঞানের মতে, কেউ দীর্ঘসময় অন্ধকারে থাকার পর তার চোখ তাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে তাকে আলোতে আনার সময় চোখ বেঁধে আনতে হয়। ধীরে ধীরে তার কাছে আলো সহনীয় হয়ে ওঠে। অন্যথায় ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে ৭২ ঘণ্টার পর হঠাত্ করে কেউ আলোতে এলে তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ৩৯১ ঘণ্টা অন্ধকারে থাকার পর রেশমাকে কেন খোলা চোখে বের করা হলো? টিভির লাইভে দেখা গেছে, স্ট্রেচারে ওঠানোর পর তিনি চঞ্চল দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাচ্ছিলেন।
সেনাবাহিনীর কথা : রেশমা ‘উদ্ধার’ প্রসঙ্গে কথা হয় সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত ৬ জুন তিনি জানান, রেশমাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ওয়েস্টিনের কর্মকর্তা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এক অস্ট্রেলিয়ান এসে নিয়ে যান। রেশমাকে আমেরিকা যাওয়ার এবং হোটেল রেডিসনে চাকরির প্রস্তাব সরকার দিয়েছিল। তবে ওয়েস্টিন হোটেল কর্তৃপক্ষ রেশমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জোড়ালোভাবে লবিং করায় সরকারও সম্মতি দিয়েছে।’
রেশমা নাটক গোপনে মঞ্চায়নের জন্য অঘোষিত রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে ওই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ঠিক কী হয়েছিল, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না। তবে তার জানামতে, অঘোষিত রেড অ্যালার্ট দেয়া হয়েছিল টেকনিক্যাল কিছু সমস্যার জন্য।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সাধারণ উদ্ধারকারী দল চেয়েছিল গর্ত তৈরি করে উদ্ধার অভিযান চালাবে, যা তাদের জন্যই বিপদের কারণ হতে পারে। তাই ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিযানের জন্য রেড আ্য্যলার্ট দেয়া হয়েছিল। সেখানে অনেকে বাড়াবাড়ি করেছে ।
রানা প্লাজায় উদ্ধার অভিযান ও রেশমা ‘উদ্ধারে’র পর সংবাদ সম্মেলনসহ সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার নেতৃত্বদানকারী সেনা কর্মকর্তা মেজর তৌহিদ উজ জামান আমার দেশকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তারা উদ্ধার অভিযানের সময় কাউকে রাখেননি। এমনকি রেশমাকে তারা সুস্থ করেই ওয়েস্টিনের কাছে হস্তান্তর করেছেন। এরপর আর রেশমার কোনো দায়দায়িত্ব তাদের হাতে রাখেননি।’
সূত্র দৈনিক আমারদেশ

No comments:

Post a Comment