প্রাসঙ্গিক বক্তব্য
সংগীত মানুষের হৃদয়ের সাথে সম্পৃক্ত। তাই মানুষ মাত্রই সংগীত বা গানের জন্য এক ধরণের ভালোবাসা বুকে রাখে। এ-ভালোবাসা কোনো লাভ-ক্ষতির হিসেব মিলিয়ে নয় বরং এটা স্বত:স্ফুর্ত এক বহমান গতি যা প্রত্যেক যুগে, প্রত্যেক কালে মানুষকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে, কেনো সংগীতের প্রতি মানুষের এমন দুর্বার আকর্ষণ। কেনো সংগীতের জন্য মানুষের হৃদয়ে বিনিময়হীন ভালোবাসা বিরাজ করে এর জবাবও রয়েছে এবং তা অত্যন্ত যুক্তিসংগত। এবং তা হলো গানের মর্মবাণীর সাথে মধুময় সুরের ব্যবহারই মানুষকে সংগীতের দিকে প্রবল আকর্ষণ করে থাকে। সুতরাং এ-কথা বলা যায় যে, গানের কথা এবং সুর এ-দুয়ে মিলে যখন মানবমনের স্বপ্ন-আশা ও সম্ভাবনার কথা উদ্ভাসিত হয় তখনই গান বা সংগীত হয়ে যায় মানুষের আত্মার স্পন্দন। মানুষ গানের মাধ্যমেই নিজেদের দু:খ বেদনার কথা প্রকাশ করে থাকে।
গান কী ?
গান আসলে কথা ও সুরের ছন্দবদ্ধ এক মনোরম শিল্প। যার মাধ্যমে মানুষ প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারে। কিংবা অনেক বেদনার ব্যথা ভুলে নতুন করে পথ চলার স্বপ্ন দেখে। মানুষ আতœার ভেতর থেকে যা কামনা করে গানের মাধ্যমে তার প্রতিধ্বনি শুনতে পায়। সুতরাং গান হলো এক ধরনের আতœার আকুতি। এ-ছাড়া যে কোন বিপ্লবকে এগিয়ে দিতে পারে গান।
গানের প্রয়োজনীয় শিল্পসৌন্দর্য
গান আর কবিতা প্রকৃত পক্ষে দুটো একেবারে কাছাকাছি। শুধু কাছাকাছি বললে যথাযথ বলা হবে না বরং গান যেটা সেটাই কবিতা হতে পারে। যাকে সাহিত্যের ভাষায় গীতিকবিতা বলা হয়। অর্থাৎ কবিতার জন্য যেমন ছন্দ, মাত্রা, তাল ও বক্তব্য দরকার তেমনি গানের জন্যও এসব কিছু প্রয়োজন। তবে গানে সুরের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। গানের মুখের অংশটি যাকে সাহিত্যের ভাষায় স্থায়ী অংশ বলে তা বারবার ফিরে আসে। যা কবিতায় নাও আসতে পারে। এছাড়া বাকী সব বিষয় কবিতার সাথে হুবহু মিল। সুতরাং গান কবিতা হতে পারে আবার কবিতাও গান হতে পারে। সে অর্থে গানে অবশ্যই কবিতার মত অলংকার থাকতে হবে। শিল্পালংকার ছাড়া গান মানসম্মত হতে পারে না।
সংগীত প্রচারের মাধ্যম
আবহমান কাল থেকে গান প্রচারিত হয়ে আসছে অডিও রেকর্ডিং এর মাধ্যমে। অবশ্য অনুষ্ঠানে শিল্পীরা সরাসরি গান পরিবেশন করেও গানের প্রচারপ্রসার করে থাকে। এছাড়া ইলেকট্রনিকস মিডিয়া, টিভি, ভিডিও, সিনেমার কোনো অংশ নিয়ে গান এবং বর্তমান সময়ে সিডির মাধ্যমেও গান প্রচারিত হচ্ছে। ছাপার অক্ষরে গানের প্রচার তেমন একটা নেই বললে চলে। তবে গানের বই প্রকাশিত হয়ে থাকে। অবশ্য তার চাহিদা খুব সীমাবদ্ধ। গান বা সংগীত প্রচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম অডিও ক্যাসেট। দ্বিতীয়ত সি.ডি. সিনেমা এবং টিভি। অডিও এ্যালবামই এখন পর্যন্ত প্রচারের সর্বশীর্ষে রয়েছে। এবং এর ধারাবাহিকতা সম্ভবত দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত থাকবে।
অডিও এ্যালবাম যেভাবে সম্পাদন করা হয়
সাধারণ একটা অডিও এ্যালবামের জন্য প্রয়োজনীয় যে দিকগুলো অপরিহার্য তা হল :
১. গীতিকার / গান
২. সুরকার / সুর
৩. শিল্পী
৪. প্রযোজক / প্রকাশক / পরিবেশক
৫. প্রচারণা / বিক্রয়।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, এই সংগীতকে সামনে রেখে কয়েক শ্রেণীর এমন মানুষ আছে, যারা প্রফেশনালি একে গ্রহণ করে সমাজে এক ধরনের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। অর্থাৎ যিনি গীতিকার তিনি গান লিখেই মর্যাদাপূর্ণ জায়গা করে নিচ্ছেন। যিনি সুরকার তিনিও এর মাধ্যমে তার অবস্থানকে উচ্চকিত করছেন। যিনি শিল্পী তারও পরিচয় শিল্পী হিসেবেই এবং এর মাধ্যমেই তার আয়-উন্নাতি, মর্যাদা রক্ষিত হচ্ছে। এছাড়া যিনি প্রযোজক তার তো এটাই ব্যাবসা। এর মাধ্যমে তিনি শিল্পপতিও হতে পারেন। এটা অবশ্য বাইরের আঙিনার কথা। এখন আমাদের প্রাসংগিকতায় আসা যাক। আমরা যারা ইসলামী সংস্কৃতি বা সুস্থসংস্কৃতির কথা বলছি, তাদের বিষয়কে সামনে এনে একটা পর্যালোচনা করলে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পাওয়া যাবে।
আমাদের গীতিকার যারা
গীতিকারদের মধ্যে যারা আমাদের অঙ্গনে পরিচিত মুখ তাদের মধ্যে রয়েছেন – কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি ফররুখ আহমদ, সিরাজুল ইসলাম, আবদুল মান্নান তালিব, কবি মতিউর রহমান মল্লিক, তাফাজ্জল হোসাইন খান, কবি আসাদ বিন হাফিজ, কবি গোলাম মোহাম্মদ, শিল্পী আবুল কাশেম, আ. জ.ম ওবায়দুল্লাহ, আবু তাহের বেলাল, চৌধুরী আবদুল হালিম, হাসান আক্তার, চৌধুরী গোলাম মাওলা, শরীফ আবদুল গোফরান, শিল্পী তারেক মনোয়ার, আমিরুল মোমেনিন মানিক, এছাড়াও এক ঝাঁক তরুণ গীতিকার রয়েছে, তারেদ নামও এখানে উল্লেখ করা হল, লিটন হাফিজ, দুররুল হক বাবলু, আবুল হোসাইন মাহমুদ, আফসার নিজাম, জুলফিকার হায়দার, নাসির মাহমুদ, মাহফুজুর রহমান, কে. এম. মনির হোসেন, আমিনুল ইসলাম, মালিক আবদুল লতিফ, আবদুর রাজ্জাক রাজু, মাহবুবুর রহমান, আবদুল্লাহ আল কাফী, আবুল আলা মাসুম, ফজলুল হক শামিল, রেজাউল করিম, সাইম উদ্দীন হাসিব, মনিরুল আলম, আবদুল আজীজ বাচ্চু, হাসিনুর রব মানু, নুসরাত নুর-উন-নাহার, মতিউর রহমান খালেদ, মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান
এবার আসা যাক প্রযোজনা প্রসঙ্গে। ইসলামী গানের এ্যালবাম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুব বেশি নয়। হাতে গোনা কয়েকটা প্রতিষ্ঠান মাত্র। এর মধ্যে আই সি এস প্রকাশনী, সি. এইচ. পি, ইসলামিক সেন্টার, প্রফের্সর বুক কর্ণার উল্লেখযোগ্য এ-ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ কেউ বা কোনো কোনো শিল্পী গোষ্ঠীও ক্যাসেট প্রযোজনা করেছে। সব চেয়ে বেশি ক্যাসেট প্রযোজনা করছে সি.এই.পি বা স্পন্দন অডিও ভিজুয়্যাল সেন্টার। দ্বিতীয়ত : আই. সি. এস প্রকাশনী। তৃতীয়ত ইসলামিক সেন্টার।
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা
যে সকল প্রতিষ্ঠান ক্যাসেট প্রযোজনা করছে। এর মধ্যে একমাত্র স্পন্দন অডিও ভিজুয়্যাল সেন্টার ছাড়া আর কেউই প্রফেশনাল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নয়। আই সি এস প্রকাশনী একটা ছাত্র সংগঠনের অধীন একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। সংগঠনের প্রয়োজনকে সামনে নিয়েই এরা ক্যাসেট প্রকাশ করে থাকে। ইসলামিক সেন্টার একটি ইনষ্টিটিউশন। এর অনেকগুলো কাজের একটি ছোট কাজ ক্যাসেট প্রকাশ করা। তাও বেশ অনিয়মিত। বাকীদের অবস্থা তথৈবচ।
স্পন্দন অডিও ভিজুয়্যাল সেন্টার প্রফেশনালী ক্যাসেট বাজারজাত করে যাচ্ছে। একক কন্ঠ, যৌথ কন্ঠ কিংবা কোনো কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাংগঠনিক ক্যাসেটও প্রকাশ করে থাকে স্পন্দন। এ-সকল ক্ষেত্রে ক্যাসেটের মাস্টার কপি এককালীন কিছু টাকা দিয়ে ক্রয় করে নেয়া হয়। এর পরিমান দশ থেকে পনের হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
ক্যাসেটের মান
প্রকাশিত ক্যাসেটের মান নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমরা বিষয়টি বেশ ক’টি দিক থেকে বিবেচনা করতে পারি।
বিষয় সমূহ
১. গানের বাণী বা কথার মান
২. গানের সুর
৩. শিল্পী বা কন্ঠ
৪. ব্যবহৃত ফিতা
৫. ক্যাসেটের প্রচ্ছদ
উপরের ৫টি বিষয়কে ৫ ভাগে নিয়ে আলোচনা করা যুক্তিসংগত হবে বলে আমরা মনে করি।
গানের বাণী বা কথা
ইসলামী গানগুলোর কথা বা বাণী এবং বাণীকে উপস্থাপনের জন্য যে শিল্পগুণ প্রয়োজন তা বর্তমানে অনেকাংশে ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে গানের বাণী একেবারে সাদামাটা এবং শিল্পগুণের দারুণ অভাব রয়েছে। অবশ্য সব গীতিকারের ব্যাপারে এবং সব গানের ব্যাপারে এটা সঠিক নয়। অনেক গানই রচিত হচ্ছে যেগুলো শিল্প সম্মত এবং বাণী বা বক্তব্যের দিক থেকে উন্নত।
তরুণ গীতিকার যারা তাদের মধ্যে কারো কারো কিছু গান মোটামুটি মানসম্মত বিবেচনা করা যায়। তবে এদের বেশির ভাগই এখনো ছন্দ, মাত্রা ও উপমা অর্থাৎ গানের শৈল্পিক বিষয়গুলো আয়ত্ব করতে পারেনি বলে সমস্যা থেকে যাচ্ছে।
এর কারণ
দুর্বল গান রচনার পেছনে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যারা দুর্বল গান লিখছেন এদের অনেকেরই ছন্দ-তাল, কিংবা মাত্রা জ্ঞান নেই। এবং জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা কম। এ-ছাড়া তাড়াহুড়ো করে একটা কিছু করে ফেলার বা গীতিকার হিসেবে নিজেকে পরিচিত করার এক ধরণের মানসিকতা থেকে এ-অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তার ওপর তাদের ভুল ত্র“টি ধরিয়ে দেবারও কেউ নেই কিংবা তারাও এ ব্যাপারে সচেতন নয় যে যারা গীতিকার হিসেবে ভালো তাদের কাছ থেকে দেখিয়ে নেয়ার প্রয়োজন আছে। ফলে গান যে মানে থাকার কথা সে মানে থাকছে না।
সুরকার
এ অঙ্গণে সুরকার হিসেবে বর্তমানে যারা পরিচিত এদের মধ্যে কবি মতিউর রহমান মল্লিক, তাফাজ্জল হোসাইন খান, শিল্পী গোলাম মাওলা, শিল্পী মশিউর রহমান, শিল্পী লিটন হাফিজ, তারিক মনোয়ার, শিল্পী সাইফুল্লাহ মানছুর, শিল্পী আবুল কাশেম, জুলকার নাইন বাহলুল। এছাড়াও তরুণ আরও কিছু মুখ রয়েছে। বর্তমানে অবশ্য সবচেয়ে বেশি সুর করছেন শিল্পী মশিউর রহমান।
সুর
সুর একটা গানকে গান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে দারুণ কাজ করে থাকে। গানের কথা যতো ভালো বা উন্নত হোকনা কেনো সুর যদি মানসম্মত না হয় তাহলে সে গান শ্রোতাদের হৃদয়ে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয় না। সে জন্য বলা যায় গানের সুরই গানকে গান হিসেবে ভালো-খারাপ প্রমাণিত করতে সাহায্য করে।
সুরের মান
আমাদের গানের মান তুলনামুলকভাবে অনেক ভালো। কিন্তু সুরের দিক থেকে আমরা সাংঘাতিক ধরণের দুর্বলতায় ভুগছি। প্রথম দিককার গানগুলো অর্থাৎ আশির দশকের পুরো সময়টা এবং নব্বই দশকের গোড়ার দিকের গানগুলোর কথা-সুর দুটোই উত্তম ছিলো। বর্তমানে সুরের মান দারুণভাবে নিচে নেমে গেছে। প্রায় একই ধরনের সুর, একই তাল-লয়ে, পরিবেশিত হচ্ছে। অবশ্য এর মধ্যে দু’চারটা গান কিছুটা ব্যতিক্রমীও হচ্ছে। কিন্তু গড়ে এসে, সুরের মান কাংখিত পর্যায়ের হচ্ছে না।
এর কারণ
১. সুর করার জন্য প্রয়োজনীয় জানা শোনার ঘাটতি অর্থাৎ সুর সংক্রান্ত পদ্ধতি জানা না থাকা।
২. পরিশ্রমী সুরকারের অভাব।
৩. তাড়াহুড়ো বা যথাযথ সময় না নেয়াও একটা কারণ।
৪. দ্রুত সুর করা, গানের সংখ্যা বাড়ানো এবং ক্যাসেটের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যেও সুর করার ক্ষেত্রে গতানুগতিক অবস্থাটা বজায় থাকছে।
শিল্পী বা কন্ঠ
গানের কথা ও সুরের পরেই আসে শিল্পীর কথা। অর্থাৎ যার কন্ঠে গানটা পরিবেশিত হয়। আসলে আমাদের অঙ্গণে এককভাবে বড় কোনো শিল্পীর অবস্থান এখনো আমাদের চোখে ধরা দেয়নি। একজন শিল্পী মানেই একটি প্রতিষ্ঠান এ-ধরনের কোনো শিল্পী আমাদের নেই। এর কারণ যাই থাক এ-বিষয়টা তিক্ত সত্য। এ-কারণে আমাদের বেশিরভাগ ক্যাসেটই যৌথকন্ঠে। ফলে সুরের ধ্বনি আমাদের মনকে তেমন স্পর্শ করে না। তবে কিছু শিশুশিল্পী রয়েছে যাদের কন্ঠ সত্যিই প্রশংসনীয়। বড় শিল্পীদের মধ্যে অনেকেরই একক ক্যাসেট রয়েছে – যেমন কবি মতিউর রহমান মল্লিক, শিল্পী সাইফুল্লাহ মানছুর, আবুল কাসেম, তারেক মনোয়ার, মশিউর রহমান। এদের প্রত্যেকের দু’একটা ক্যাসেট বেশ মানসম্মত উপায়ে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এদের কেউ শেষ পর্যন্ত নিজস্ব সাধনায় নিজেদের প্রতিভাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে একাগ্র সাধনায় রত হয়নি। যার ফলে এই শূণ্যতা। এদের মধ্যে আবার অনেকে গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই থাকেন নি।
কারণ সমূহ
১. প্রফেশনালি এটাকে নেয়ার সুযোগ না থাকা
২. ব্যক্তি ও সংগঠনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব
৩. অর্থনৈতিক সমস্যা, এ সমস্যাটা এমন যে, এখানে কোনো শিল্পের বিনিময়ে শিল্পীরা জীবন ধারণের উপকরণ সংগ্রহ করতে পারে না
৪. পৃষ্ঠপোষকতার দরুণ অভাব
৫. ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনে সিরিয়াস না হওয়া
৬. ব্যক্তিগত লক্ষ্য নির্ধারণের শিথিলতা
৭. মিডিয়ার অভাব।
ব্যবহৃত ফিতা বা প্রোডাক্টশন
গান, সুর ও শিল্পীর পরে যে বিষয়টা এসে দাঁড়ায় তা হল ক্যাসেটের প্রোডাকশন বা প্রকাশনা। এক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের অসতর্কতার মধ্যে রয়েছি আমরা। অর্থাৎ প্রকাশনার মান খারাপ বললেও কিছুটা কম বলা হবে। এটাকে নিুমানের বলাই যথাযথ হবে। একটা ক্যাসেট কয়েকবার শুনলেই ফিতা নষ্ট যায়।
অসতর্কতা এর কারণ সমূহ
১. ক্যাসেটের ফিতা মান সম্মত নয়
২. রেকর্ডিং সিস্টেম আধুনিক নয়
৩. কপি যথাযথ রেকর্ডেড হয় না
৪. ব্যবসায়িক স্বার্থকে বড় করে দেখা।
এ-ব্যাপারে প্রায় সারাদেশ থেকেই অভিযোগ রয়েছে। এ-অভিযোগ অনেক ক্ষেত্রেই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে জানানোর পরও কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি।
ক্যাসেটের লেভেল বা প্রচ্ছদ
ক্যাসেটের লেভেল বা প্রচ্ছদ আগের তুলনায় কিছুটা উন্নত হয়েছে এ-কথা স্বীকার করা যুক্তিসংগত। কিন্তু তবুও কেনো যেনো সীমা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে অসুবিধা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ক্যাসেটের লেভেলেও কিন্তু একটা শিল্পগুণ অপরিহার্য। সর্বোপরি কথা হলো, সব কিছু মিলিয়ে আমাদের বর্তমান সময়ের ক্যাসেটগুলো আগের তুলনায় অনেকাংশেই মানের দিক থেকে খারাপ। অথচ সুযোগ-সুবিধা আগের চেয়ে অনেক বেশি। সুযোগের যথাযথ ব্যবহার আমরা করতে পারছি না।
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। তারা শিল্পীদের পারিশ্রমিক কিছুটা হলেও দিয়ে থাকে। তবে সেটা খুবই নগণ্য কিন্তু গীতিকারদেও তেমন কোনো সম্মানীই দেয় না বা এ-ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহও নেই। ফলে যারা ভালো গীতিকার তারা গান লিখছেও কম। পক্ষান্তরে নতুন গীতিকার যারা তারা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য যেনতেন আকারে গান লিখে সুরকার ও প্রযোজকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। প্রযোজক ও সুরকারও এ-সুযোগের ব্যবহার করে মানহীন গানের ক্যাসেট মার্কেটে ছেড়ে দিচ্ছে। ক্রেতারা ভালো ক্যাসেট না পেয়ে যা বের হয় তাই ক্রয় করে থাকে।
তবে এতোসব সমস্যার কথা যে বলা হলো এর জন্য এককভাবে কেউ যেমন দায়ী নয়, আবার কেউ এ-দায় থেকে মুক্ত নয়। সুতরাং সামগ্রিকভাবে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক মিডিয়াকে মোটেই সাজিয়ে তুলতে পারিনি। আমরা বরাবরই অন্যদের সমালোচনায় মুখরিত হই। নিজেদের দায়িত্ব পালনে দারুণ শীতলতায় ফ্রিজ হয়ে থাকি। আমরা যদি সামগ্রিকভাবে এর কারণ খুঁজতে যাই তাহলে যে-সব কারণগুলো বেরিয়ে আসবে তা হল :
কারণসমূহ
১. প্রফেশনালী সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে ধারণ করেত না পারা। এ-ক্ষেত্রে যারা আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে তারা যথাযথ ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসছেন না।
২. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় না থাকা। সমন্বয় বলতে, সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অভিজ্ঞ লোকদের সুন্দর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় না।
৩. মান নিয়ন্ত্রণের অভাব : মান নিয়ন্ত্রণ বলতে সঠিক তত্ত্বাবধান এবং সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে মানসম্পন্ন ক্যাসেট প্রকাশ করার ব্যবস্থা নেয়া।
৪. সুনির্দিষ্ট লক্ষের অভাব
৫. সাংগঠনিক দৃষ্টিভংগীর অস্বচ্ছতা, এখানে বলে রাখা ভালো যে সাংগঠনিকভাবে শিল্পাঙ্গণ-কে প্রফেশনালি ডেভেলপ্ করার পরিকল্পনা আসলেই নেই।
এ-সকল সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য যে সকল কাজ আমাদের করণীয় তা হল :
যা করণীয়
১. সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে প্রফেশনালী অগ্রসর করানোর কার্যক্রম সিরিয়াসলি হাতে নিতে হবে। যাতে ছোটবেলা
থেকে শিল্পীরা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে।
২. এক বা একাধিক ভালো মানের ষ্টুডিও এবং প্রোডাক্টশন হাউজ প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
৩. মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটা কমিটি থাকা প্রয়োজন।
৪. সমন্বয় করাও অপরিহার্য
৫. গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী এ-তিন শ্রেণীর কর্মীদেরকেই যথাযথ পারিশ্রমিক দেয়ার ব্যবস্থা করা বিশেষ
প্রয়োজন।
এ-ছাড়া যে সকল সমস্যা দেখা দিয়েছে এর যথাযথ সমাধান একান্তভাবে প্রয়োজন। আর সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে ক্যাসেটের মান আরো নিচে নেমে যাবে। এর মাধ্যমে কারো কারো কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জিত হলেও সাংস্কৃতিক অঙ্গণ ক্রমান্বয়ে কলষিত হয়ে যাবে বলে আগাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করা যায়। তবে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ক্যাসেট প্রকাশের বিষয়টাকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ। কেননা এর মাধ্যমে গীতিকার, সুরকার, শিল্পীরা যেমন নিজেদের মান উন্নয়নের সুযোগ পায় তেমনি নতুন প্রতিভাবানদের আবিষ্কার করাও সহজ হয়।
সুতরাং দেশ, দেশের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং ইসলামী আন্দোলনের স্বার্থে এ-বিষয়ে তড়িৎ সমাধানের বিষয়টি হাতে নেয়া অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি।
মূল লেখক : জাকির আবু জাফর ...গীতিকার , কবি ,সুরকার
No comments:
Post a Comment