জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক আবু সালেহ সেকেন্দার ফোন করেছিলেন। বললেন, জাসদ নিয়ে অনেক কথাবার্তা লেখালেখি হচ্ছে। আপনি কিছু বলছেন না যে? আপনি তো জাসদের জন্ম থেকে ছিলেন। অনেক কিছু জানেন যা আমাদেরও জানার প্রয়োজন হতে পারে। লিখুন না।
আবু সালেহ সেকেন্দার হয়তো জানেন না জাসদ নিয়ে এ পত্রিকায় ৯ জুলাই আমি একটি লেখা লিখেছিলাম। মাত্র ২২ বছর বয়সে আমি জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। তখনো আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ চাকসুর সাধারণ সম্পাদক। স্বাধীনতার পরে এই একটি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে ছাত্রলীগ জিতেছিল। তখনো ছাত্রলীগ ভাঙেনি। কেন্দ্রসহ সারা দেশে মুজিববাদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের লড়াই শুরু হয়েছে। স্পষ্টত সমাজ বিপ্লবের বক্তব্য দিয়ে ওই নির্বাচনে আমি অংশ নিয়েছিলাম এবং জয়লাভের পরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলাম। '৭২-এ পল্টনে ছাত্রলীগের সম্মেলনে সে কারণে আমাকে বিশেষ বক্তা রাখা হয়েছিল রাতের অধিবেশনে। কিন্তু ছাত্রলীগের এক নেতা, মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর ইনস্ট্রাকচার, পরবর্তীতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি, '৭৩-এ হাইজ্যাক হয়ে যাওয়া ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ী সহ-সভাপতি আ ফ ম মাহবুবুল হক রাত ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত একনাগাড়ে ৪ ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। যখন তার বক্তৃতা শেষ হয় তখন আমি আর বক্তৃতা করিনি। কিন্তু একটি আবেশ আমাকে জড়িয়ে রেখেছিল। রাত ২টা পর্যন্ত এই যে ছাত্রকর্মীদের বক্তৃতা শোনা, এখন তো কল্পনাই করতে পারি না।
তখন আমি বলতে পছন্দ করতাম, জাসদ আমার প্রথম প্রেম। এটি একটি ভালোবাসার ও নিবেদনের কথা। ভালোবাসা কেবল যে নারী-পুরুষেই হয় এমন তো নয়। ভালোবাসা একটি আদর্শের প্রতি, দলের প্রতি, দেশের প্রতিও হতে পারে এবং কোনো কোনো সময় তা মানব-মানবীর প্রেমের চেয়েও বড় হতে পারে। উদারহণ দেওয়া যাবে কিন্তু তাতে লেখার কলেবর বাড়বে। আমি এ কথাগুলো বললাম এ কারণে যে, তারুণ্যের ওই সময় জাসদকে যে ভালোবাসতাম তা মনে পড়লে কষ্ট পাই। কী অদ্ভুত সম্ভাবনা ছিল আমাদের মধ্যে। '৭৩-এর ডাকসু নির্বাচনে, যে নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে গিয়েছিল মুজিববাদী ছাত্রলীগ। আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী ছাত্ররা সমর্থন জানিয়েছিল। আমাদের প্যানেল মাহবুব-জহুর পরিষদকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারা পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিল। আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম এক স্বপ্নের বাংলার। সোনার বাংলার। গড়ে কত বয়স হবে জাসদ নেতা-কর্মীদের? জাসদ সভাপতি মেজর জলিল বোধহয় ৩০ পার হয়েছিলেন, সাধারণ সম্পাদক আ স ম রব ৩০ ছুঁতে পারেননি। অথচ প্রচণ্ড তেজে, অমিত সাহসে যখন তারা রুখে দাঁড়াল আওয়ামী লীগের রিলিফ চুরি, লুটপাট আর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তখন মানুষ তাদেরই প্রধান বিরোধী দল হিসেবে গ্রহণ করে নিল। আওয়ামী লীগ আর জাসদ রাজনীতির মাঠে, এ দুটোই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল। দুটোই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। আজ গণজাগরণ মঞ্চ যে আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছে সেটা গড়ে উঠেছিল তখন। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, রাজনীতির পুরো দৃশ্যে পাঠটাই বদলে গেছে, কেন?
বোম্বের এক হিন্দি ছবির নায়ক-নায়িকার দেখা হয়েছে দীর্ঘদিন পরে। দুজনেই দুজনকে চাইত। তবুও দীর্ঘদিন পর দেখা। কার দোষে? নায়িকা জিজ্ঞাসা করল, সব দোষ কি আমারই ছিল! নায়কের জবাব- কিছু দোষ তোমার ছিল, কিছু ছিল আমার। আর কিছু ছিল আমাদের দুজনের সম্মিলিত।
পাঠকবৃন্দ, আমি কোনো সিনেমার কাহিনী বানাচ্ছি না। বাস্তব সিনেমা থেকে অনেক আলাদা। আর রাজনীতি তো আরও নিষ্ঠুর। যে সিরাজুল আলম খান ছিলেন কারও কারও মতে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে আস্থাভাজন মানুষ, তিনি বক্তব্য দিয়েছিলেন শ্রেণী সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কর। শ্রেণী সংগ্রাম কি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর বিরোধিতাকারী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কি একই শ্রেণীভুক্ত? তাদের মধ্যে সংগ্রামটাই তো চূড়ান্ত। অতএব জাসদের মধ্য থেকে বক্তব্যে এসেছিল আওয়ামী সরকারকে উৎখাত কর। এখানে কোনো পেইন নেই, ভালোবাসা নেই। বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারটাও দেখুন, সবাইকে ভালোবাসেন তিনি, সবাইকে বকেনও কিন্তু গেলেন রেসকোর্সে মুজিববাদীদের সম্মেলনে। সিরাজুল আলম খানের সম্মেলনে নয়। নিজের ভাগিনা শেখ মণির সম্মেলনস্থলে। যদি তিনি তখনই কোথাও না যেতেন তাহলে তখনো ছাত্রলীগ ভাঙত না।
এ কথাগুলো বলছি আমার গত লেখার কথা স্মরণ করে। জাসদ নেতা মঈনুদ্দিন খান বাদল বলেছিলেন, পিতার সমালোচনা করে যদি কোনো ভুল করে থাকি তবে সেই ভুলের কাফফারা দিচ্ছি এখন। একই কথা তিনি অতঃপর চট্টগ্রামের এক সংবাদ সম্মেলনে বললেন। কি লজ্জা। পিতার সমালোচনা করা পাপ নাকি? ছেলে কি পিতার সব কথা শোনে। পিতার কথার অবাধ্য হয়ে যে নিজের পছন্দমতো বিয়ে করে তা কি পাপ? আর কি কাফফারা দিচ্ছেন তারা? ভুল যদি করে থাকেন তবে সেটা হলো স্বাধীনতার পরপরই শ্রেণী সংগ্রামের বক্তৃতা দেওয়া, সদ্য প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী সরকার উৎখাতের আহ্বান জানানো। আর সে জন্য গণআন্দোলনের ছেদ ঘটিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া, গণবাহিনী গড়ে তোলা। কিন্তু তারপরেও জাসদ তো সেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিত্রতা করেছে। জাসদ সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব আওয়ামী সরকারের সময় মন্ত্রী হয়েছেন আর বর্তমান সভাপতি হাসানুল হক ইনু আরও দীর্ঘ সময় মন্ত্রী থাকার জন্য প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বেগম খালেদা জিয়াকে তুলাধোনা করতে ছাড়ছেন না। বলি হারি যাই এদের অমিত যোগ্যতা দেখে। আর শেখ হাসিনা পারেনও বটে। কখনো রব কখন ইনু। কী অদ্ভুত কম্বিনেশন।
১৯৭৪-র ১৭ মার্চের পর থেকে '৭৫-র ৭ নভেম্বর পর্যন্ত জাসদের রাজনীতি ছিল অ্যাডভেঞ্চারে ভরা। গণবাহিনী, সমরসেন হাইজ্যাকের চেষ্টা, ৭ নভেম্বর এবং তার পরবর্তী অভ্যুত্থানের চেষ্টা- সবই ছিল উগ্র হঠকারিতায় ভরপুর। ফলে তছনছ হয়ে যায় জাসদ, আবারও গণআয়তনে ফিরে আসার সুযোগ পায় দলটি। কিন্তু তীব্র মতবাদিক সংগ্রামে আরও বিদীর্ণ হয় তারা। যাও ভুল হয়েছিল তা বুঝে, ধরতে পেরে সুধরে নেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু তখনকার প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব কোনো ভুল স্বীকার করতে রাজি হননি। ফলে শক্তি সঞ্চয় করার বদলে দলটি ভেঙে চৌচির হয়ে গেল।
আমার খানিকটা দায় আছে। খানিকটা নয়, হয়তো অনেকটাই। জাসদ ছিল মূলত ছাত্র তরুণদের ওপর নির্ভর এবং সেই ছাত্র সংগঠনের সব গুরুদায়িত্বই আমি পালন করেছি। ততখানি দায় তো আমার আছেই। সেই বোধ থেকেই তৎকালীন পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে আমাদের করণীয় সম্পর্কে একটি লেখা লিখেছিলাম। 'শুধুমাত্র সদস্যদের জন্য' এ শিরোনামে ওই লেখাটি একটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। পুস্তিকাটি এখন আমার কাছে নেই। এ সুযোগে আমি পাঠকদের অনুরোধ করছি, যদি কারও কাছে বইটি থাকে মেহেরবাণী করে আমাকে জানালে বাধিত হব। আগ্রহীদের আমি বই পড়ে দেখতে অনুরোধ করব। আমার কোনো দায় থাকলে আমি তা মাথা পেতে নেব। কিন্তু তখনকার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কোনো কারণ ছাড়া বইটি নিষিদ্ধ করলেন কেন? তাও জানা দরকার। দোষ নিশ্চয়ই একা কারও নয়। কিন্তু ইতিহাস যার দায়িত্ব যতখানি নির্দিষ্ট করেছে ততখানি তো তাকে নিতে হবে।
মঈনুদ্দিন খান বাদল যে কাফফারা দেওয়ার কথা বললেন, সে কোনো ভুলের? আমি যা বললাম (যা বিস্তারিত বলতে পারলাম না) তার জন্য? ভুল বা অন্যায় তখনকার সরকার করেনি? বঙ্গবন্ধু করেননি? '৭৩-এর ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট বাক্স হাইজ্যাকের জন্য আওয়ামী লীগের কোনো অনুশোচনা আছে? জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১০-১২ আসন ছিনিয়ে নেওয়া হলো, সেটি কি গণতন্ত্র হত্যার সূচনা নয়? যে খন্দকার মোশতাককে এখন বঙ্গবন্ধুর খুনি বলা হচ্ছে (তাতে সন্দেহ করছি না) সেই পরাজিত খন্দকার মোশতাককে বিজয়ী করার জন্য দাউদকান্দি থেকে তার ব্যালট বাক্স ঢাকায় আনা হয়নি? শতমুখী প্রচারণার পরেও বাকশালের গঠন একটি সঠিক পদক্ষেপ ছিল বলে কি প্রমাণ করা গেছে? বঙ্গবন্ধু কাকে বেশি পছন্দ করতেন, খন্দকার মোশতাক নাকি তাজউদ্দীন আহমদ? সে প্রশ্নের কি জবাব ইতিহাসের কাছে আছে? এ প্রশ্ন কি করা যাবে? মঈনুদ্দিন খান বাদল কোন ভুলের কথা বলছেন যে, ভুলের কাফফারা তিনি দিচ্ছেন এখন? কি কাফফারা দিচ্ছেন? তারা যে জোটের অংশীদার তাদের দলের কয়েকজন ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের এমপি, একজন দাপুটে মন্ত্রী, এটা কি কাফফারা দেওয়া।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
No comments:
Post a Comment