একাত্তরে বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানীদের বর্বরতা ও নৃশংসতার কাহিনী শুনলে গা শিউরে ওঠে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভের পরও বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন অব্যাহত থাকে। বাহাত্তর থেকে পচাত্তর এ কয়েক বছরে ২৫ হাজার বিরোধী বামপন্থী রাজনীতিক, পরাজিত বিহারী, রাজাকার ও শান্তি কমিটি, ইসলামপন্থী এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দুদেরকেও পাকিস্তানীদের মতোই পাশবিক কায়দায় হত্যা করে রক্ষী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ। কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ডের খবর ব্যাপকভাবে জাতির সামনে আসেনি।
স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মতপার্থক্যজনিত বিরোধের ফল হিসেবেই আওয়ামী লীগ বিরোধী মুক্তিযোদ্ধা ও বামপন্থীরা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক হত্যার শিকারে পরিণত হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এসব হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রশক্তি এবং আওয়ামী লীগের দলীয় শক্তি ব্যবহার করা হয়।
আহমদ মুসা তার ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ বইয়ে লিখেছেন, “আওয়ামী লীগ শাসনামলে যেসব প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার ও তার নীতির বিরোধিতা করেছে, সেসব দলের মতে, সে আমলে ২৫ হাজার ভিন্ন মতাবলম্বীকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ। এ হতভাগাদের হত্যা করা হয়েছে চরম নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার মধ্য দিয়ে- যে নৃশংসতা অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানী সৈন্যদেরও ছাড়িয়ে গেছে। খুন, সন্ত্রাস, নির্যাতন, হয়রানি, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন কোনো কিছুই বাদ রাখা হয়নি।”
বামপন্থীদের ওপর হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মাওলানা ভাসানীর হক কথা লিখে, “একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা বিশেষ প্রোগ্রামে এ দেশে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের হিসেব হলো, বাংলাদেশে সোয়া লক্ষ বামপন্থী কর্মীকে হত্যা করতে হবে। তা না হলে শোষণের হাতিয়ার মজবুত করা যাবে না।” (২৬ মে-১৯৭২ : সাপ্তাহিক হক কথা)
স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞে শেখ মুজিবের ভূমিকার এক ভয়ঙ্কর তথ্য জানা যায় মাসুদুল হক রচিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এবং সিআইএ' গ্রন্থে। ঐ গ্রন্থের ১০৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে,‘১৯৭২ সালে একদিকে তিনি (মুজিব) সকল মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেন, অপরদিকে আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খানকে অস্ত্র জমা দিতে বারণ করলেন। শেখ মুজিবের ওই নিষেধ সম্পর্কে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সিরাজুল আলম খান আর আমাকে ডেকেই বঙ্গবন্ধু (শেখ মুজিব) বলেছিলেন, সব অস্ত্র জমা দিও না। যেগুলো রাখার দরকার সেগুলো রেখে দাও। কারণ, সমাজ বিপ্লব করতে হবে। প্রতি বিপ্লবীদের উৎখাত করতে হবে, সমাজতন্ত্রের দিকে এগুতে হবে। এটা আমাদের পরিষ্কারভাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন।
সুতরাং মুজিব আমলে এসব হত্যাকাণ্ড যে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় মদদে হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এবার আমরা আওয়ামী লীগ ও রক্ষীবাহিনীর নির্মমতার কিছু কাহিনী তুলে ধরবো।
মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর
“ঢাকা জেলার মনোহরদী থানার পাটুলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মকর্তার দলীয় কর্মীদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত শত্রুতা সাধনের উদ্দেশ্যে জনৈক মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর দিয়েছে। এই অপরাধে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করিয়া নারায়ণগঞ্জ থানায় চালান দিলে জনৈক এমসিএ হস্তক্ষেপ করিয়া এই নরঘাতকটিকে মুক্ত করিয়াছেন।(২ জুন-১৯৭২ : সাপ্তাহিক হক কথা )
‘তোর নিজের হাতে ছেলের গলা কেটে দে, ফুটবল খেলবো তার মাথা দিয়ে’
আহমেদ মুসা তার ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ' গ্রন্থের উৎসর্গনামায় আওয়ামী ঘাতক বাহিনীর অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার বাজিতপুরের ইকুরটিয়া গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক আব্দুল আলীর অভিজ্ঞতার বর্ণনা তুলে ধরে লিখেছেন, ‘....ঐখানে আমাকে (আব্দুল আলী) ও আমার ছেলে রশিদকে হাত-পা বেঁধে তারা খুব মারলো। রশিদকে আমার চোখের সামনে গুলী করলো। ঢলে পড়লো বাপ আমার। একটা কসাই আমার হাতে একটা কুঠার দিয়ে বলল, তোর নিজের হাতে ছেলের গলা কেটে দে, ফুটবল খেলবো তার মাথা দিয়ে। আমার মুখে রা নেই। না দিলে বলল তারা, তোরও রেহাই নেই। কিন্তু আমি কি তা পারি? আমি যে বাপ। একটানা দেড় ঘণ্টা মারার পর আমার বুকে ও পিঠে বন্দুক ধরল। শেষে নিজের হাতে কেটে দিলাম ছেলের মাথা। আল্লাহ কি সহ্য করবে?"
ময়মনসিংহে এক হাজার ৫শ' কিশোরকে হত্যা
“....রক্ষীবাহিনী গত জানুয়ারীতে এক ময়মনসিংহ জেলাতেই অন্তত এক হাজার ৫শ' কিশোরকে হত্যা করেছে। এদের অনেকেই সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (ইবিসিপি)-এর সদস্য ছিল। অন্যদের মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। এমনকি অনেক বাঙ্গালী যুবক যারা রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় ছিল না, তারাও এই সন্ত্রাসের অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন... বস্তুত বাংলাদেশে বীভৎসতা ও নিষ্ঠুরতার অভাব নেই।”(ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ : আহমেদ মুসা, পৃষ্ঠা-১৩৬)
রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছিল হত্যাযজ্ঞের আখড়া
‘মুজিববাদীদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সন্ত্রাসের রাজনীতি, প্রকাশ্য হত্যা, গুপ্ত হত্যা, গুন্ডামি এগুলো ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছিল হত্যাযজ্ঞের আখড়া। যশোরের কালীগঞ্জ থেকে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প উঠে গেলে সেখানে গণকবর আবিষ্কৃত হয়-যেখানে ৬০টি কঙ্কাল পাওয়া যায়। টঙ্গী থানার সামনে মেশিনগান স্থাপন করে শ্রমিক কলোনীর উপর নির্বিচারে গুলী চালানো হলো। শতাধিক নিহত হলেন। হাজার হাজার শ্রমিক বিশ মাইল হেঁটে ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হল এবং তারা তিনদিন তিনরাত পল্টন ময়দানের উন্মুক্ত আকাশের নিচে অবস্থান করতে বাধ্য হল।' (বাম রাজনীতি : সংকট ও সমস্যা' -হায়দার আকবার খান রনো)
(মুজিব আমলে আওয়ামী লীগ ও রক্ষী বাহিনীর নির্যাতন সম্পর্কে কোন তথ্য থাকলে এখানে শেয়ার করতে পারেন)
No comments:
Post a Comment