Friday 27 September 2013

তৌফিক এলাহীরা সরকারকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন

গোলাম মোর্তোজা : ‘প্রধানমন্ত্রী দেশে নাই। শুরু হয়েছে ভয়াবহ লোডশেডিং’Ñ এটা সরকার পক্ষের কারও কারও অভিযোগ। অভিযোগের ধরনটি এমন যে, বিদ্যুৎ সেক্টরের লোকজন সরকারকে বিপদে ফেলার জন্যে লোডশেডিং করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ঠিকই আছে, সরকারকে বিব্রত করাই তাদের লক্ষ্য। এ বিষয়ে সরকারের কর্তাদের মেজাজ খারাপ করে দেওয়া কিছু তথ্য ও কয়েকটি অগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

১. প্রধানমন্ত্রী তো বিদ্যুৎ সঙ্গে নিয়ে আমেরিকায় যাননি। বিদ্যুৎ উৎপাদন যদি ঠিক থেকে থাকে, তবে সেই বিদ্যুৎ কোথায় গেল?

২. লোডশেডিং কেন হচ্ছে- সেই প্রশ্ন করবে জনগণ। সরকারের লোকজনও যদি প্রশ্ন করে, তবে কাজ করবে কে?

৩. বিদ্যুতের চাহিদা কত, উৎপাদন কত, চুরি কত- সবই ডিজিটাল। জানা খুব সহজ। যদি সত্যি স্যাবোটাজ হয়ে থাকে, তবে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?

৪. সরকারি তথ্য অনুযায়ী উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদা প্রায় ৭ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদন হচ্ছে হঠাৎ দু’একদিন ৬ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। এছাড়া প্রতিদিন আসলে উৎপাদন হচ্ছে ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট।

ক. প্রতিদিন উৎপাদন ঘাটতি দেড় হাজার থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট।

খ. উৎপাদন ক্ষমতা যদি ৯ হাজার মেগাওয়াট হয়, উৎপাদন কেন ৫ হাজার বা ৬ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট?

৫. রেন্টাল বা কুইক রেন্টালে সরকার পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। উৎপাদন না হলেও কুইক রেন্টাল ব্যবসায়ীদের কোনো ক্ষতি নেই। ক্যাপাসিটি ট্যাক্স তারা ঠিকই পাচ্ছে। যেমন একটি কুইক রেন্টাল কোম্পানির গত এপ্রিল মাসের হিসাব থেকে দেখা যায় তারা ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎও উৎপাদন করেনি। কারণ সরকার জ্বালানি সরবরাহ করতে পারেনি। কিন্তু তারা এপ্রিল মাসে বিল পেয়েছে ৯ কোটি টাকা।

৬. প্রায় সব রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মালিকরা এভাবেই লাভবান হচ্ছে। মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ জনমানুষকে।

৭. চুক্তি অনুযায়ী সরকার জ্বালানি দিতে না পারলে ক্যাপাসিটি ট্যাক্স দেবে। জ্বালানি দেয়ার পরও কুইক রেন্টাল কোম্পানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারলে, সরকারকে ক্ষতিপূরণ দেবে। বা¯ত্মবে জেনারেটর অকেজো থাকার কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হয়ত চালু করতে পারছে না। ক্ষতিপূরণ যেখানে পাওয়ার কথা সরকারের, সেখানে ঘটছে উল্টো ঘটনা। কাগজে কলমে দেখানো হচ্ছে মেশিন ঠিকই আছে, সরকার জ্বালানি দিতে পারছে না। ফলে মেশিন চালু না করেও প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে কুইক রেন্টাল কোম্পানিগুলো।

সরকার মাঝেমধ্যে কিছু ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে। তবে সবকিছু মিলিয়ে অর্থ লুটের এক অভিনব উপায় রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ব্যবসা।

৮. অতিদ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে কুইক রেন্টাল হতে পারত সর্বোচ্চ এক বা দুই বছরের জন্যে। কিন্তু সরকার চুক্তি করেছিল ৩ বছরের জন্যে। এখন আবার সেসব চুক্তির মেয়াদ আরও দুই তিন বছর করে বাড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ অস্থয়ী ব্যবস্থাকে স্থায়ী করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।

৯. এখন উৎপাদন ক্ষমতা ৯ হাজার মেগাওয়াট। সেটাই উৎপাদন করা যাচ্ছে না। তবে কেন আরও নতুন কুইক রেন্টাল কোম্পানির অনুমোদন দেয়া হচ্ছে? অর্থ হরিলুট?

১০. বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের জন্যে কুইক রেন্টাল কোনো সমাধান নয়। প্রয়োজন ছিল এই পাঁচ বছরে কয়েকটি বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করা। কিন্তু সেদিকে সরকারের নজর ছিল না। পিডিবির অকেজো হয়ে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মেরামতেরও কোনো উদ্যোগ সরকার নেয়নি।



১১. দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করলে পিডিবির বন্ধ হয়ে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। মেরামতের দিকে দৃষ্টি ছিল না সরকারের।

১২. বর্তমান সরকার যেদিন দায়িত্ব নেয় সেদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল প্রায় ৩ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। এখন গড় উৎপাদন ৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ধরলে উৎপাদন বেড়েছে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ উৎপাদন ৬ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ধরলে উৎপাদন বেড়েছে ২৭০০ মেগাওয়াট।

১৩. সব হিসেবের মারপ্যাঁচ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে কুইক রেন্টালের ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্যে বছরে মোট ভর্তুকি দিতে হয় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। এগুলো অনুমান নির্ভর লেখা নয়। তথ্য-প্রমাণ যাচাই বাছাই করে লেখা। এবার হিসাব করে দেখেন, ২৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্যে কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে, হচ্ছে!

১৪. অথচ মাত্র ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ করলে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। যার উৎপাদন খরচ হতো প্রতি ইউনিট ৩ থেকে সর্বোচ্চ ৫ টাকা। তেল দিয়ে উৎপাদন করলেও এই খরচ হতো। কুইক রেন্টাল থেকে যেখানে সরকার কিনছে ১৪ টাকা ইউনিট।

১৫. যত বেশি অর্থ ব্যয়, তত বেশি লাভ, তত বেশি আয়। জনগণের নয়, সরকার সংশ্লিষ্টদের!

১৬. সুন্দরবন ধ্বংস করে সরকার এখন ভারতীয় কোম্পানিকে দিয়ে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে চাইছে। এর বিরুদ্ধে চলছে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, লংমার্চ। অথচ রামপালের পরিবর্তে লবণচড়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র করলে কোনো বিতর্ক উঠত না।

রামপাল থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব সরকার বলছে ১৪ কি. মি.আসলে দূরত্ব ৯ কি. মি. লবণচড়ার দূরত্ব প্রায় ৩৫-৪০ কি. মি.।

১৭. বিতর্কিত জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক এলাহী চৌধুরী ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন আগামী ২২ অক্টোবর রামপালে ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করা হবে। যুক্তি নয়, একগুঁয়েমি আর গায়ের জোর সরকারের একমাত্র সম্বল।

১৮. ইতিহাস বলে, জনমানুষের বিপক্ষে গিয়ে কোনো কাজে সফল হওয়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গের টাটার আলোচিত ন্যানো প্রকল্পের নন্দীগ্রাম ইস্যুতে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল।

আড়িয়াল বিলের বিমানবন্দর পরিকল্পনা থেকে সরে এসে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার একবার রক্ষা পেয়েছে।

রামপাল ইস্যুতে তৌফিক এলাহীরা সরকারকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন, কে জানে! সুত্র : সাপ্তাহিক আজকাল, নিউইয়র্ক ।
http://www.amadershomoybd.com/content/2013/09/28/news0042.htm

No comments:

Post a Comment